যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রুহেল আহমেদ বাবু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরে কুকিতল সাবসেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক শেখ জাহাঙ্গীর আলম
রুহেল আহমেদ বাবু মুক্তিযুদ্ধ করেন বড়লেখা, ছোটলেখা, জুড়ি, দিলখুস, লাটিটিলা, সোনারুপা, বিয়ানীবাজার প্রভৃতি এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের সাবমেশিন গানের তিনটি গুলি লাগে তার বাঁ পায়ের গোড়ালির ওপরে। ২৫ মার্চ রাতে কলাবাগান ধানমন্ডি এলাকার রাস্তায় গাছ কেটে ব্যারিকেড দিয়ে বাঁধার সৃষ্টি করেন তিনিসহ তার সহযোগীরা। রুহেল আহমেদ বাবু তার মায়ের জোড়াজুড়িতে অংশ নিয়েছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। এই বীর যুদ্ধের ইতিহাস বলতে গিয়ে তার দেখা অনেক ঘটনায় গ্রামের কৃষক-শ্রমিকসহ আপামর মানুষের অবদানের কথা তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পার হয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের জন্য কল্যাণমূলক কিছু কাজ করতে চান এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রুহেল আহমেদ বাবু।
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বুয়েটের ছাত্র। ৭ মার্চের পর দেশের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন রুহেল আহমেদ বাবু। তার অবদান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা মনে করেন যে আমরা দুঃসাহসী ওরকম কিছু না। যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন একটা বিড়াল কিন্তু তিনটা কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই সাত কোটি মানুষের মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। আরও বেশি নয় কেন? অনেকে যেতে চেয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন অসুবিধার কারণে তারা যেতে পারেনি। কিন্তু যারা রাজাকার, আলবদর হয়নি, আলসামস হয়নি, দেশে থেকে যারা ভুক্তভোগী হয়েছে-তারা সবাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা।
দেশের সাধারণ মানুষের কেমন ভূমিকা ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাটাই নয়, আমরা যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আমাদের শেল্টার দেওয়া, সহযোগিতা করা, খাবার খাওয়ানো, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে গ্রামের মানুষ। তাদের অবদান কিন্তু অনেক বেশি। আমরা ভেতরে ঢুকে ঠুসঠাস করে চলে আসলাম, এরপর যারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছে তারা কিন্তু অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেককে মেরেও ফেলেছে। বিয়ানীবাজারে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সময় আমাকে হেল্প করেছিল, তাদের মধ্যে দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
‘৪ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর প্রথম শুরুটাই আমার নেতৃত্বে হয়েছিল। আমার সাবসেক্টরে প্রায় ৭/৮শ’ ছেলে-পেলে ছিল। আমি যুদ্ধাহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলাম। আহত হওয়ার পর স্কোয়াড্রন লিডার নুরুল কাদের সেই সেক্টরের দায়িত্ব নেন এবং পরিচালনা করেন। যুদ্ধে আমি আহত হলে ভারতের একটি হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু যখন কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন, বাংলাদেশের প্রথম যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধের একটি গ্রুপকে জার্মানিতে পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেখানে ১৮ মাস চিকিৎসা হয়েছিল আমার। আমার পায়ে তিনটি গুলি লেগেছে আর হাঁটুতে একটা মোটরসাইলো লেগেছে, যা এখনও আছে, বের করা হয়নি। এরপর জার্মানি থেকে আমি ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আসি। এর জন্য দীর্ঘদিন আমার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট ছিল না। তবে আমার সেক্টরের ছেলেরা অনেকেই বীর বিক্রম, বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন।’
সময়ের আলো/আরএস/