জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা মোটাদাগে প্রশ্নবিদ্ধ। আবার এ পুলিশই মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনে ছিলেন অগ্রগামী ভূমিকায়, যাদের হাত ধরে প্রথম শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ। আবার যুদ্ধের পরে প্রায় সব সরকারের আমলেই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে। ফলে বাহিনীটি বিভিন্ন সময় গায়ে জড়িয়েছে কলঙ্কের চাদর।
সাবেক ও বর্তমান পুলিশ সদস্য, মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, ঊর্ধ্বতনদের আদেশ মেনে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় চরম মূল্য দিতে হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান দুই ক্ষেত্রেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জীবন দিতে হয়েছে। তাই পুলিশ বাহিনীকে তাদের নিজেদের মতো করে বাহিনী পরিচালিত করতে দিতে হবে বলেও মতামত ব্যক্ত করেন তারা।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা : বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় ১৯৭১ সাল। স্বাধীনতার জন্য এ বাহিনীর সদস্যদের চরম আত্মত্যাগ শিকার করতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রাম, রণাঙ্গনে যুদ্ধ, মুক্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই প্রদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। পুলিশের বীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে এখানকার পুলিশ সদস্যরা সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা ২৫ মার্চ ঢাকার রাজারবাগের পুলিশ লাইন্সে ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মর্টার, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী ভাবতে পারেনি ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেল দিয়ে তাদের মোকাবিলা করা হবে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। এ সশস্ত্র প্রতিরোধটিই বাঙালিদের কাছে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর বার্তা পৌঁছে দেয়। পরে পুলিশের এই সদস্যরা ৯ মাস জুড়ে দেশব্যাপী গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১ হাজার ২৬২ জন শহিদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণের সংবাদ কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া পুলিশ ওয়ারলেসের মাধমে দেশব্যাপী পুলিশের কাছে পৌঁছে দেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে পাঠানো এ সংবাদ দেশের প্রায় সব জেলা, মহকুমা ও থানায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলায় পুলিশ সদস্যরা নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। অবশ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানা না থাকায় দেশের কয়েকটি জেলা শহরে হানাদারদের আকস্মিক আক্রমণে পুলিশ সদস্যরা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এক পর্যায়ে পুলিশ লাইন্সের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে বেশিরভাগ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন।
জুলাই-আগস্টে পুলিশের ভূমিকা : জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত এবং মারমুখী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বাহিনীর সদস্যরা। নিহত ও আহত হয়েছে হাজারো মানুষ। মারা গেছে পুলিশও। পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, জুলাই-আগস্টে ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, এ ছাড়া আহত হয়েছেন অনেকে। বিগত দিনের এবং জুলাই-আগস্টে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে পুলিশের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলি ও মানুষ হত্যার ঘটনায় শহিদ পরিবারগুলোর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের চার মাস পর চলতি মাসের প্রথম দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ ছাড়া ডিএমপি কমিশনার ও র্যাবের ডিজিও ক্ষমা চেয়েছেন। এ অবস্থায় পুলিশের অতীত দুর্নাম ঘুচিয়ে পুলিশ জনআস্থা অর্জন করতে চায়। এ পরিকল্পনা থেকেই জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে সরকার। কমিশন পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে কাজ করছে।
পুলিশের একাত্তর ও চব্বিশের ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধে ও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা পুলিশের যে ভূমিকা দেখেছি সেটি একেবারেই মানুষের ভেতরের যে চাওয়া ছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেছিল। সেই কারণে তারা রুখে দিতে পেরেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। আর জুলাই-আগস্টে যেটি করেছে সেটি তো আর বাহিনীর দোষ নয়, যারা তাদের পরিচালিত করেছে তারা এটিকে দলীয় আজ্ঞাবাহী বাহিনীতে রূপান্তরের চেষ্টা করেছিল।’ এ কারণে নির্বিচারে গুলি, হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ অন্যতম মন্তব্য করে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল পুলিশের। প্রথম প্রতিরোধ রাজারবাগ থেকেই হয়েছে। পুলিশই প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা। আমাদের পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত-আহত হলেন।’ জুলাই-আগস্টে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে যে ঘটনা ঘটল এটা ভয়ংকর। পুলিশের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা বলছেন আমাদের এটি (জুলাই-আগস্টের ভূমিকা) ভুল ছিল।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সে সময়ে স্থাপত্যের ছাত্র রুহেল আহমেদ বাবু রাজারবাগে আক্রমণের সময় তিনি তার জিপে করে এই এলাকায় গিয়েছিলেন। রাজারবাগ আক্রমণের তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম ত্যাগ স্বীকার করেন পুলিশ সদস্যরাই। তাদের ভূমিকা অবর্ণনীয়। যত ধরনের ফোর্সেস ছিল সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে এবং অত্যাচারিত হয়েছে।’ জুলাই-আগস্টে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে পুলিশ যেটি করেছে, তারা ঊর্ধ্বতনদের আদেশে করেছে। তবে নির্মমভাবে মারাও গেছে। মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছে পুলিশ, এখনও মারা গেছে পুলিশ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকার বিষয় চিন্তা করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। গর্বে সিনা টান হয়ে যায়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, দেশের সব ক্রান্তিকালে পুলিশ বাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানেই ভালো-খারাপ মানুষ থাকে। তাই পুলিশেও রয়েছে।’ জুলাই-আগস্টের ভূমিকা নিয়ে তারা বলেন, পুলিশ সিনিয়রদের কমান্ড মেনে চলে। তারা যেভাবে কমান্ড দিয়েছে মাঠে পুলিশ সেভাবে কাজ করেছে। পুলিশ আর সরকারের পোষ্য বাহিনী হিসেবে কাজ করতে চায় না। সংস্কার করে পুলিশকে নিজেদের আইন মতো চলতে দেওয়া হোক, দেখবেন দেশের মঙ্গল হবেই।
দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ অ্যাক্টের ৫ নম্বর ধারার অধীনে ১৮৬১ সালে পুলিশ বিভাগ গঠন করে তখনকার ব্রিটিশ সরকার। এরপর থেকে ‘পুলিশ আইন ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-১৯৪৩’-এর বিধিবিধান অনুযায়ী বর্তমান পুলিশ বিভাগ পরিচালিত হয়। মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স জারি করে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে শুরু হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কার্যক্রম। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যক্রম চালু করা হয়। বর্তমানে দেশে ৮টি মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।