৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা।বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন সাধ পূরণ হয় এ মাসে।
এ মাসেই হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর, আল-শামসদের সহযোগিতায় দেশের মেধাবী-শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেওয়ার এ ধরনের ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় কোনো নজির বিশ্বে নেই।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯টি মাস। এই ৯ মাসকে কেন্দ্র করেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়, দেখেছি সহযোদ্ধার লাশ আর আপন সন্তানের নিথর দেহ।
২৫ মার্চ ক্র্যাক ডাউনের পর ২৭ মার্চ হেঁটে, রিকশা এবং নৌকায় অনেক কষ্টে নরসিংদী পৌঁছলাম। চলতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যোগাযোগ হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর নূরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি ক্যাপ্টেন মতিউরকে পাঠালেন যুদ্ধ প্রস্তুতির সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে গিয়ে ক্যাপ্টেন মতিউর আবার নরসিংদী এলেন ৩০ মার্চ, সঙ্গে বহু ইপিআর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রসহ। নরসিংদীর জনগণ উজ্জীবিত হয়ে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। ২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিউরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। বিকালে নরসিংদীর পাঁচদোনা পৌঁছলে পাকিস্তানি বাহিনী নৌ, রেল ও স্থল তিন দিক থেকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। শত্রুবাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাদের অতর্কিত আক্রমণে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ চালাতে থাকলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর ৮-১০ জন সৈন্য হতাহত হলো। উড়িয়ে দেওয়া হলো তাদের দুটি গাড়ি। আমাদের কয়েকজন হতাহত হলো। সেই স্মৃতি এখনও আমাকে নাড়া দেয়। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখলেও কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে হৃদয়ে প্রলয় নাচন শুরু হলো। উপলব্ধি করতে লাগলাম সুসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের।
নরসিংদীর স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রস্তুতি নিলাম ভারত যাওয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকামীদের প্রথম এবং সহজতম আশ্রয়স্থল ছিল ত্রিপুরার আগরতলা। আগরতলা পৌঁছলাম। পেলাম পরিচিত মুখ মেজর নূরুজ্জামানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও ঢাকার অনেক সংগঠকের। আগরতলা মুখরিত হলো মুক্তিকামী বাঙালিদের পদভারে।
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান অদ্ভুতভাবে গাঁথা বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতের অন্যান্য অংশ যেখানে একদিক থেকে বেঁধে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তিন দিক থেকে আলিঙ্গন করে আছে ত্রিপুরাকে। ত্রিপুরার ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের ৮৩৯ কিলোমিটারই বাংলাদেশের সঙ্গে।
রাজধানী আগরতলা, যেখানে আর্যদের পা পড়েনি, আসেনি কোনো বিদেশি। সারা বাংলায় যখন বাংলা ভাষার সরকারি মর্যাদা ছিল না, ইংরেজি ও ফার্সি যখন সবকিছুর ওপর দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার রাজভাষা তখনও বাংলা। পাহাড়ি ত্রিপুরার যে হৃদ্যতা, সেই হৃদ্যতা ক্রমশ বাড়া বৈ কমেনি। মহারাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ইতিহাস তেমনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে পরবর্তী প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসীর তেমন ইতিহাস। ১৯৭১ সালে সমগ্র ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৩ লাখ অথচ ত্রিপুরা ধারণ করেছিল ১৩.৪২ লাখ বাংলাদেশ ত্যাগী শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১-এর এপ্রিল মাসে আমি আগরতলা যাই। সেখানে সর্বজনাব কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার, মেজর নূরুজ্জামান প্রমুখ নেতার সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টার। সংগঠক হিসেবে সে সময়ে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পসহ ত্রিপুরার অনেক ক্যাম্পেই প্রতিনিয়তই যেতে হতো আমাকে। সূর্যমনিনগর হাসপাতাল যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। পরিদর্শনে গিয়ে দেখা হলো আমার স্কুলজীবনের বন্ধু ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। এ সময় অর্থাৎ ২৮ মে তৎকালীন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কথা বলারও সুযোগ হয় আমার।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে এমপি, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিলে আমি ১ জুন হোমনার এমপি অধ্যাপক মোজাফফর আলী ও আলীসহ হবিগঞ্জের মাধবপুর বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করি। রাত ২টা ৩০ মিনিটে বর্ডার ক্রস করতে সাহায্য করলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন। সকালে চারগাছ বাজারে চা-নাশতা করার সময় লক্ষ করলাম স্থানীয় লোকজন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। সে সময় দেশে শক্রমিত্র চেনা খুবই দুরূহ ছিল। সে কারণে দেরি না করে হোমনার উদ্দেশে রওনা হলাম। সারা দিন চলার পর রাতে ঝড়-বাদলে মাঝি পথ হারিয়ে ফেলাতে অনেক কষ্টে ৩ জুন সকালে মোজাফফর আলী এমপির এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম।
পরদিন সকালে বাঞ্ছারামপুরের এমপি মহিউদ্দিনের খোঁজে তার এলাকায় গিয়ে তাকে পেলাম ডোমরাকান্দিতে। এরপর রায়পুরার এমপি আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলো নিলিক্ষায়। শিবপুর-মনোহরদীর এমপি ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হাইরমারা প্রামে। তাদের সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর মেসেজ জানাই এবং তারা সবাই আগরতলায় তথা ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন।
এভাবে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে এমপি, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার কার্যক্রম চালাই। ২২ জুন নিজ গ্রাম নরসিংদীর আলোকবালীতে যাই।
অপেক্ষা করছিল দুঃসংবাদ। জানতে পারলাম আমার সন্তান বিপ্লবের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংবাদ। চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ। আমাদের বাড়িতে ২৯ জুন রাতে পরিবার-পরিজনসহ এলেন নরসিংদীর এমপি মোসলেহউদ্দিন। তাকে পেয়ে আমার কাজে অনেকটাই সুবিধা হলো।
এ সময় আলোকবালী নিরাপদ নয় ভেবে পরিবার-পরিজন স্থানান্তর করলাম বাঞ্ছারামপুরে। সেখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলো আমার ছোট মেয়ে সুইটি। পরে সেও হোমনাতে মারা গেল এক ধরনের বিনা চিকিৎসায়। পরিবার-পরিজন রেখে ৩০ জুলাই আবারও ঢাকার পথে রওনা হলাম। পায়ে হেঁটে, নৌকায়, রেলপথে ও রিকশায় অনেক কষ্টে ঢাকায় পৌঁছালাম ৩ আগস্ট রাতে। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মান্ডা, মুরাদপুর ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ১৭ আগস্ট নরসিংদী রওনা হয়ে ১৯ আগস্ট পৌঁছালাম। নরসিংদী তখন ভীষণ উত্তপ্ত। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য তখন চরমে। এর মধ্যেই বাড়াইল হয়ে আমার গ্রাম আলোকবালীতে পৌঁছালাম।
এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে আবারও রওনা হলাম আগরতলার উদ্দেশে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে দুয়েক জায়গায় ছদ্মবেশে অনেক বিপদ এড়িয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করলাম। ২৫ সেপ্টেম্বর মেজর নূরুজ্জামান ও ২৬ সেপ্টেম্বর গাজী গোলাম মোস্তফাকে দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম। এরপর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গাজী গোলাম মোস্তফা ও আমি আগরতলা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে ভারতেই ছিলাম, দেশে আর আসা সম্ভব হয়নি। সেখানে আমরা নিয়মিত তাদের খোঁজ নিয়েছি এবং খাবারসহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করেছি।
সেখান থেকে দেশে এলাম ১৪ ডিসেম্বর মেজর হায়দারসহ হেলিকপ্টারে কুমিল্লায়। পরে নরসিংদী হয়ে ঢাকায় এলাম ১৫ ডিসেম্বর বিকালে। যাত্রাবাড়ীতে সেদিনই বিজয় উল্লাস। সেই স্মৃতি সারাজীবন মনে রাখার মতো, জনতা মেজর হায়দার ও আমাকে মাথায় নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় নাচতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর কাটল আনন্দ আর উৎকণ্ঠায়। অবশেষে এলো জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকা ক্লাব থেকে আনা হলো চেয়ার-টেবিল, যে টেবিলে স্বাক্ষরিত হলো বাঙালির বিজয়ের দলিল। ১৬ ডিসেম্বরের সেই দৃশ্য সুখ-স্বপ্ন হয়ে আছে এখনও।
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা
সময়ের আলো/আরএস/