দাম বাড়ানোর পর চট্টগ্রামে সয়াবিন তেলের সরবরাহ মাত্র কয়েকদিন স্বাভাবিক ছিল। সারা দেশের মতো চট্টগ্রামে ফের দেখা দিয়েছে সংকট। বিশেষ করে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কাটেনি। কয়দিন আগে পলিপ্যাকে সয়াবিন তেলের সরবরাহ মিললেও এখন তাও মিলছে কম। কোথাও পাওয়াই যাচ্ছে না।
ক্রেতারা দুই লিটার চাইলে দেওয়া হয় এক লিটার। আবার পাইকারি দোকানে বোতলজাত তিন লিটার সয়াবিন তেল চাইলে দেওয়া হয় দুই লিটার। বাকি এক লিটার পলিপ্যাক নেওয়ার অনুরোধ করেন দোকানি। বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল পর্যাপ্ত নেই। তাই ক্রেতাদের আমরা পলিপ্যাক ভর্তি সয়াবিন তেল নিতে উৎসাহিত করছি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি সয়াবিনের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিতে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক করেনি সিন্ডিকেট। তাই দাম সহনীয় পর্যায়ে না এসে উল্টো নানা ধরনের সংকট হচ্ছে।
রোববার সকালে নগরীর বৃহত্তম কাঁচাবাজার বহদ্দারহাট ও চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, সব মুদি দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট রয়েছে।
ক্রেতারা বলছেন বোতলজাত সয়াবিন তেল দিতে। আর বিক্রেতা বলছেন পলিপ্যাক নিয়ে যান। পলিপ্যাক নিয়ে যেতে বিক্রেতারা রীতিমতো উৎসাহিত করছেন। বহদ্দারহাট হক মার্কেটের পেছনে মেসার্স আরজু ট্রেডার্সের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ক্রেতারা তো বোতলভর্তি সয়াবিতন তেল চায়। কিন্তু আমরা সরবরাহ পাচ্ছি না। পলিপ্যাকের সরবরাহ মোটামুটি ভালো আছে। বোতলভর্তি সয়াবিন তেলেরই সংকট বেশি। আর কতদিন এই সংকট চলবে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, মিল মালিক-পাইকারদের কাছ থেকে সরবরাহ ভালো পেলে সংকট থাকবে না। তবে আমরা চলমান সংকট কতদিন চলবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কম। চাহিদার বিপরীতে টানা ঘাটতি লেগেই আছে। পাইকারদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল না পেয়ে ফিরে যান খুচরা ব্যবসায়ীরা।
ক্রেতারা মনে করেন পাইকারি আড়ত থেকে উধাও হয়ে গেছে সয়াবিন তেল। কোনো কোনো পাইকারি আড়তে বোতলজাত সয়াবিন মিললেও পরিমাণে খুবই কম। মণপ্রতি হিসাব করে দ্ইু লিটারের বোতল দিতে বললে অনেক খুচরা ক্রেতাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার ভোজ্য তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এখন প্রতি লিটার বোতলজাত ১৬৭ টাকার সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি লিটার ১৪৯ টাকার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৭ টাকায়। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৮১৮ টাকা থেকে বেড়ে ৮৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতারা মনে করেন বছরের এই সময়ে ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে।
ক্রেতাদের প্রশ্ন, সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েও যদি সরবরাহ সংকট থাকে তবে সুফল নিচ্ছে কারা। তাদের মতে, সরকার শক্তভাবে বাজার তদারকি না করলে সংকটের ধারা অব্যাহত থাকবে। ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মিলে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। সে সঙ্গে কমানো হয়েছে তেলের সরবরাহও। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সরবরাহ পাচ্ছেন না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাজারে সয়াবিন তেলের আরও সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কা আছে। সরকার দুই দফায় শুল্ক-কর কমালেও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। দাম কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।
একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ওঠানামার মধ্যে আছে। গত সপ্তাহে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ সয়াবিন বিক্রি হয় ৬ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৬ হাজার ৭৫০ টাকায়। এখন একলাফে ২০০ টাকা বেড়ে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৯৫০ টাকায়। প্রতি মণ সয়াবিন তেল লিটারে ভাগ করলে দাম পড়ে ১৭২ টাকা। খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৭৪-১৭৭ টাকায়। কোথাও লিটারে ৮০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, সয়াবিন তেলের দাম ওঠানামার জন্য আড়তদারদের কোনো ভূমিকা নেই। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মিল থেকে উৎপাদন সরবরাহ স্বাভাবিক রাখলে ঘাটতি হয় না। কিন্তু কখনো মিল থেকে সরবরাহ ঘাটতি হলে সংকট দেখা দেয়। বর্তমানে মিলগুলো থেকে সরবরাহ উদপাদন স্বাভাবিক আছে কি না জানা নেই।
ক্যাবের বিভাগীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সরবরাহ ঘাটতির সময় খোলা ও বোতলজাত দুই ধরনের সয়াবিন তেলের দামই বাড়ানো হয়েছে। এরপর কিছুদিন সরবরাহ স্বাভাবিক হতে না হতেই আবার সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ মজুত করে অপরাধ করে একবার পার পাওয়ায় সেই সুযোগ আবার নিতে চাচ্ছে অসাধু মিল মালিকরা। অর্থাৎ মজুত করে সম্প্রতি দুই ধরনের সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে।
তারা মনে করছে আবার সংকট সৃষ্টি করলে হয়তো আরেক দফা দাম বাড়ানো যাবে। এ জন্য দাম বাড়ানোর পরও সয়াবিনের সংকট কাটেনি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, আমরা এক সপ্তাহ আগে নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানির মিল পরিদর্শন করেছি। সেখানে মজুত পর্যাপ্ত দেখেছি। এমনকি সয়াবিনের সরবরাহও ভালো। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই মুহূর্তে বাজারে দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা বাজার মনিটরিং অব্যাহত রেখেছি। তবে আমাদের কাছে কোথাও বাড়তি দামে বিক্রি করছে এমন কোনো তথ্য নেই।
অন্যদিকে আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে সয়াবিন তেলবাহী জাহাজ নিয়মিতভাবেই আসছে। গত ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে সয়াবিন তেলবাহী চারটি জাহাজ ভিড়েছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে আসা চার জাহাজে ৫২ হাজার অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়েছে। এসব সয়াবিন তেল খালাস শেষ হওয়ার পরপরই মিলগুলোতে পরিশোধন শুরু হবে। এরপর বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়ে যাবে। এই চারটি জাহাজ ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলবাহী আরও কয়েকটি জাহাজ আসার শিডিউল রয়েছে।
সময়ের আলো/আরএস/