প্রকাশ: রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩:১১ এএম (ভিজিট : ৫৪)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ঝালকাঠির প্রতিটি থানা ও গ্রাম পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। এমনি হাড় হিম করা নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার দক্ষিণ কাঠিপাড়া গ্রামে।
১৯৭১ সালের ১৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় কাঠিপাড়া গ্রামের অধিবাসী ও সেই গ্রামে আশ্রয় নেওয়া শত শত শরণার্থীর ওপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষকে হত্যা করে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় বহু নারীর ওপর। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা নারী-পুরুষের মধ্যে ২২ জন পুরুষ ছিলেন বিবাহিত। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডে মুহূর্তের মধ্যে বিধবা হয়ে যান ২২ জন নারী। এ জন্য পরবর্তী সময়ে কাঠিপাড়া গ্রামের একটি অংশ বিধবা পল্লী হিসেবে পরিচিতি পায়। কাঠিপাড়া গ্রামে হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞে স্বামী হারানোর শোকে এখনও কাঁদেন বিধবা পল্লীর অসহায় নারীরা।
কাঠিপাড়া গণহত্যার পরিধি দক্ষিণ কাঠিপাড়া থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী নারিকেলবাড়িয়া, লেবুবুনিয়া, সাতুরিয়া, নৈকাঠিসহ কয়েকটি গ্রামজুড়ে বিস্তৃত। মূল গণহত্যাটি ঘটে শুক্তাগড় ইউনিয়নের দক্ষিণ কাঠিপাড়ায়। এ জন্য গণহত্যাটি কাঠিপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। ২০১০ সালে কাঠিপাড়ায় গণকবর খুঁড়ে ২৫ জনের মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে সরকারিভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা এই এলাকায় আরও গণকবর রয়েছে। সঠিক স্থান নির্বাচন করে খনন করলেই পাওয়া যাবে শহিদদের দেহাবশেষ।
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মুনসুর আহমেদ বলেন, সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী কাঠিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়ংকর নির্যাতন চালায়। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। এ আক্রমণে মদদ দেয় নৈকাঠি ও শুক্তাগড় ইউনিয়নের রাজাকার নেতারা। কাঠিপাড়ার ঠাকুরবাড়ি নামক স্থানটিতে তৎকালীন সময়ে গভীর জঙ্গল ছিল। সেখানে প্রাণ বাঁচাতে শত শত নিরীহ মানুষ আশ্রয় নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই অঞ্চল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঝালকাঠি শহর দখলে নেয়। কাঠিপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে এখানে আশ্রয় নেয়। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় হিন্দুরা কাঠিপাড়া গ্রামের ঘন জঙ্গলে পালিয়ে থাকত। সেখানে বহু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির খবর হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেয় রাজাকাররা। দিনটি ছিল ১৭ মে, সোমবার। সকাল ৭টার দিকে হানাদার বাহিনী আসছে জানতে পেরে স্থানীয়রা জীবন বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করে। দলে দলে ঘন জঙ্গল ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু রাজাকারদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি তারা। গণহত্যার দিন কাঠিপাড়ার তিন দিক থেকে প্রবেশ করে পুরো জঙ্গল ঘিরে ফেলে হানাদাররা। এরপর গুলি করতে করতে জঙ্গলের ভেতর চালায় ব্যাপক গণহত্যা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে একে একে অন্তত অর্ধশত লোককে গুলি করে হত্যা করে। সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে এই হত্যাযজ্ঞ। সেদিন সকালে একই পরিবারের ৮ জনসহ অর্ধশত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
জঙ্গল ছাড়াও খালের ভাসমান কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেওয়া অনেক মানুষকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্থানীয় রাজাকার আইয়ুব আলী কুপিয়ে হত্যা করে কার্তিক চন্দ্রকে। সেদিন রাজাকার ও লুটেরা বাহিনী গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং সম্পদ লুট করে।
আগ্রহ বাড়ছে পানিফলে