শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ছিল গতকাল। দিবসটি স্মরণে একাত্তরে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার জাতির সূর্যসন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে রাজধানীর মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং বৈষম্যহীন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে সারা দেশে পালিত হয়েছে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
দিবসটি উপলক্ষে শনিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি প্রথম শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। পরে শ্রদ্ধা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধা নিবেদনের পর উপদেষ্টামণ্ডলী, শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন বয়সি, বিভিন্ন পেশার হাজারো মানুষ আসে স্মৃতিসৌধে। শোক আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে যাওয়া জাতির মেধাবী সন্তানদের। সকাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রায়েরবাজার শহিদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমি-স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। ফুলে ফুলে ভরে যায় স্মৃতিসৌধের বেদি।
শনিবার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গার্ড অব অনার দেয় তিন বাহিনীর একটি দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন দল ও অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ সময় বিএনপিসহ দলটির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের দলীয় বিভিন্ন স্লোগান গান দিতেও দেখা যায়। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং যুদ্ধাহত ও উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা শনিবার সকাল ৭টা ২২ মিনিটে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সর্বস্তরের জনগণ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়।
এরপর শহিদ পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, আমরা একাত্তর, ডিসেম্বর ১৯৭১ উদযাপন পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, ছায়ানটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় শহিদ পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়েন এবং অন্যদের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন। অনেকেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অনেক সাধারণ মানুষকেও শহিদদের কবরের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আবার অনেককে ফাতেহা পাঠ করে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করতে দেখা গেছে। পরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ভিড় কমতে থাকে। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষে সংবাদপত্রে বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। সভার শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এতে শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. সাজেদা বানু। তিনি শহিদ বুদ্ধিজীবী ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদের বোন।
উপাচার্য বলেন, ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আজকের এদিনে জাতির সূর্যসন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি। এ দিবসগুলো আমাদের মূল পরিচয়ের স্মারক। আমরা এ সূর্যসন্তানদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থান এ বছর আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ জাতি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। তারা আমাদের যে দায়িত্ব দিয়ে গেছে, সেটি পালন করাই আমাদের কাজ।’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে সকালে ইউজিসি কর্তৃপক্ষ মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ সময় ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান ও প্রফেসর ড. মো. সাইদুর রহমান, ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া, ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশন বিভাগের পরিচালক মোছা. জেসমিন পারভীনসহ অন্যান্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলামের নেতৃত্বে সকাল ৮টায় মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল ১০টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এদিকে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কুরআন খানি ও আলোচনা সভা এবং বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনা শেষে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মো. মিজানুর রহমান।
সকালে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফ সোহেল বলেন, ৭১ এবং ২৪ নিয়ে একটি মহল জল ঘোলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্টের দোসররা বারবার দেখানোর চেষ্টা করছে, আমরা তরুণ প্রজন্ম যারা রক্ত দিয়ে নতুন বাংলাদেশকে নিয়ে এসেছি, তা ৭১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা ২৪-কে মনে করি ৭১-এর ধারাবাহিকতা। আমরা ৭১-এর লড়াইকে একটি চলমানতার সঙ্গে দেখতে চাই।
কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের প্রেসিডিয়াম সদস্য শ্যামল বিশ্বাস বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও মানবিক, গণতান্ত্রিক ও সমতার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায়নি। এ কারণেই গত ৫ আগস্ট একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এখন স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলেই কেবল অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পাশাপাশি মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে উঠবে।’
প্রসঙ্গত, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের শেষলগ্নে পুরো দেশের মানুষ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে। বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে বাঙালিকে মেধাশূন্য করার এ নৃশংস নিধনযজ্ঞ সেদিন গোটা জাতিসহ পুরো বিশ্বকেই হতবিহ্বল করে দিয়েছিল। এর দুদিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে ঘাতক চক্র কেবল ঢাকা শহরেই প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার কৃতী মানুষকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে সেই রাতে তালিকা ধরে ধরে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভূতুড়ে অন্ধকারে। পরদিন সকালে ঢাকার মিরপুরের ডোবা-নালা ও রায়েরবাজার ইটখোলাতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় অনেক নিথর দেহ। কারও শরীর বুলেটবিদ্ধ, কারও অমানুষিক নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত। হাত পেছনে বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নাড়িভুঁড়িও বের করে ফেলা হয়েছে অনেকের। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে উন্মুখ মানুষ স্বজন হারানোর সেই কালরাত্রির কথা জানতে পেরে শিউরে উঠেছিল। স্থবির হয়ে গিয়েছিল সবকিছু। হত্যার পূর্বে যে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল, সে তথ্যও বের হয়ে আসে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের রচিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, নিহত শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
সময়ের আলো/আরএস/