মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় থিতু হতে হবে বাংলাদেশকে। গত ৫৩ বছরেও বাংলাদেশ সব মানুষের রাষ্ট্র হতে পারেনি। তাই বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা, সব নাগরিকের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।
শনিবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৪ উপলক্ষে সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার উদ্যোগে ‘ধর্মীয় ও জাতিগত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও। ঐক্য মোর্চার পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রঞ্জন কর্মকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু আজ অবধি তা অধরাই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রধর্ম বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম সাংঘর্ষিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আমাদের একটি ইউনিভার্সেল আইডেন্টিটি প্রয়োজন, যা ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ রোগের লক্ষণ, মূল হলো সাম্প্রদায়িকতা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চেয়েছিল বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে এসেছিল। ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কেন কমছে, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য থাকলে কেন মন্দির, মসজিদ, গির্জা ও প্যাগোডা পাহারা দিতে হবে?
তিনি জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন। এটা আজ বিশ্বজনীন বাস্তবতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, গত ৫৩ বছরে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয়েছে নানাভাবে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্যতা ও বলার স্বাধীনতা। আজকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কেন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হলো তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজকে তাদের কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ করা যায়নি। যখনই কোনো সরকার পরিবর্তন হয়েছে তখনই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে নির্যাতন নিপীড়ন নেমে আসে।
তিনি আরও বলেন, যেদিন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কবর হবে সেদিনই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু শব্দগুলো থাকবে না। আজকে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে সর্বজনীন আন্দোলনে নিয়ে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
মানবাধিকার কর্মী শামসুল হুদা বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পেছনে বৈষয়িক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত না হলে সে রাষ্ট্র সভ্য রাষ্ট্র হতে পারে না।
ফাদার অ্যালবার্ট টি রোজারিও বলেন, সংখ্যালঘুরা ট্রাম্পকার্ড হিসেবে সব সরকারের আমলেই ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
থিওফিল নকরেক বলেন, সংবিধানে জাতিগোষ্ঠীর যথাযথ স্বীকৃতি নেই। আদিবাসীরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চায়। ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭, ১৬৯ কার্যকর করতে হবে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আজ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে। রাজপথের আন্দোলন ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
এতে আরও বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক সাইফুর রহমান তপন, সাংবদিক বাসুদেব ধর, জয়ন্ত কুমার দেব, সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, অধ্যাপক চন্দন সরকার, ডা. এস কে রায়, অতুল চন্দ্র মণ্ডল, মনিরুজ্জামান এবং রাজ কুমার দাস।
বক্তারা আরও বলেন, আলোচনায় সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে সব সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
আলোচনাসভায় বলা হয়, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তসহ যেসব সংখ্যালঘু নেতার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে তা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। সংখ্যালঘু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীসহ যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবিও জানানো হয়।
সময়ের আলো/আরএস/