ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

গৌরবদীপ্ত অধ্যায়
প্রকাশ: রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:০২ এএম আপডেট: ১৫.১২.২০২৪ ৮:৫১ এএম  (ভিজিট : ২০৭)
বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্ব ইতিহাসে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। একাত্তরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রাণ বিসর্জন, মা-বোনের সম্ভ্রব হারানোর মর্মন্তুদ বেদনায় ভরপুর। দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালি স্বদেশে, রণাঙ্গনে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বহুজনের বিবিধ বিসর্জন শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পাতাকা ওড়ে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 

পেছনে ফিরে দেখা যাক। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি মুসলিম মানসে আশার সঞ্চার করলেও পরবর্তী সময়ে দুই অঞ্চলের বৈষম্য ও শোষণ বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের দমনপীড়ন, বঞ্চনা, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক নতুন মাইলফলক। ধারাবাহিক সংগ্রামে যুক্ত বাঙালি দীপ্ত পথভারে মুখরিত হয়।

১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ১০টি আসন লাভ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। 

 পাকিস্তান সরকার ৫৬ দিন মন্ত্রিসভার কার্যক্রম সচল রাখে। ১৯৫৬ সালে পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগ ১৯৫৬-৫৮ পর্যন্ত রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু করে। এ সময় রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে বিশেষ বিধান বলবৎ করা হয়। ব্যাপক গ্রেফতার চলে। বাঙালি প্রতিরোধে ফুঁসে ওঠে। ১৯৬২ থেকে ৬৪ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন মূল ধারার রাজনীতিতে গতিবেগ সঞ্চার করে। পাকিস্তানি শাসকদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে ছাত্ররা ‘শরিফ কমিশন রিপোর্ট’ প্রত্যাহরে আন্দোলন তীব্র করে তোলে। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা উত্থাপন করেন। সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে আনা, ট্যাক্স ধার্য ও বৈদেশিক মুদ্রার স্বতন্ত্র হিসাব নির্ধারণ ও প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের ক্ষমতা অর্জনসহ বিবিধ বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। 

ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা মামলা করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এ সময় আন্দোলন চলাকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা, ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামন ও মতিউর রহমানকে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ঘাতকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সারা দেশ আন্দোলন-সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বাধ্য হয়ে অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহর করে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছাত্রসমাজ পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক নতুন মাইলফলক সূচনা করে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে ১১ দফা ঘোষিত হয়।

১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে বসতে না পারায় জনরোষ বৃদ্ধি পায়। 

এ সময়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনীর সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় গুরুত্ব পায়। এ অঞ্চলের জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে।

 ইতিমধ্যে বেলুচিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানকে পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলে, অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বিদেশি গণমাধ্যমে যাতে গণহত্যা সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রচার না পায় সেজন্য বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়। বিভিন্ন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ঢাকায় গণহত্যা পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলে।

২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য। মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় ১৭ এপ্রিল সরকার শপথগ্রহণ করে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ২৫ মার্চের মতো। রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের গলিত মরদেহের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্বজনরা ভিড় করেছে। অনেক প্রিয়মুখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে সরকার নিরন্তর কাজ করে। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেওয়া যোদ্ধা ও বীরের আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান অধিকার করে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা পরাজিত হয়। 

সামরিক-বেসামরিক যোদ্ধারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্যে খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অধিকাংশ সাধারণ জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে ও সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা আলোচনার পাদপ্রদীপে আসেননি। সিংহভাগ মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত ‘স্বাধীনতা’ অর্থবহ করে তুলতে হবে। উন্নয়ন সামগ্রিক এক অবস্থা। উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে, আর্থ-সামাজিক কাঠামো মজবুত দৃঢ়করণে অধিক মনোযোগ প্রয়োজন।

প্রাবন্ধিক, কর্মকর্তা, জাতীয় জাদুঘর

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close