ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা, জমা করা অর্থ থেকে নগদ উত্তোলন করা, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা, ব্যাংক থেকে এলসি খোলা অথবা অন্য যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হোক না কেন, এর সবকিছুকেই গ্রাহকসেবা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে ব্যাংক থেকে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যে ধরনের সুবিধাই গ্রহণ করা হোক না কেন
ব্যাংক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান এবং একমাত্র প্রোডাক্ট হচ্ছে গ্রাহকসেবা। ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা, জমা করা অর্থ থেকে নগদ উত্তোলন করা, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা, ব্যাংক থেকে এলসি খোলা অথবা অন্য যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হোক না কেন, এর সবকিছুকেই গ্রাহক সেবা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে ব্যাংক থেকে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যে ধরনের সুবিধাই গ্রহণ করা হোক না কেন, ব্যাংকার সেবা প্রদানের মানসিকতা নিয়ে গ্রাহকের চাহিদামতো কাজটা করে দেবে। ব্যাংকে গ্রাহকের আর্থিক লেনদেনের কাজটি করতে যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে ব্যাংকাররা সদা সচেষ্ট থাকবে। ব্যাংকিং সেবা সংক্রান্ত এসব মূল্যবান কথা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে যে নেই তা আজকাল ব্যাংকে কোনোরকম লেনদেনের জন্য গেলেই টের পাওয়া যায়। উল্টো ব্যাংকে সেবা নিতে গেলেই নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হাতে হয়।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ব্যাংক থেকে যেকোনো ধরনের সেবা নিতে গেলেই বিড়ম্বনা বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হিসাব খুলতে, অর্থ উত্তোলন করতে, অর্থ স্থানান্তর করতে, ঋণ গ্রহণসহ এমন কোনো কাজ নেই, যা নিতে গেলে ব্যাংকে সমস্যায় বা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। হ্যাঁ, কথা সত্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয় না, কারণ ব্যাংক তাদের পছন্দমতো যতসব কাগজপত্র দিতে বা স্বাক্ষর করতে বলবে, তার সবকিছু যদি না বুঝে স্বাক্ষর করে দেওয়া হয়, তা হলে আর কোনো সমস্যা হয় না। বাস্তবে অধিকাংশ গ্রাহকরা হয় না বুঝে অথবা নিরুপায় হয়ে ব্যাংকের চাহিদামতো কাগজপত্র স্বাক্ষর দিয়ে থাকেন এ জন্য সমস্যার বিষয়টি সেভাবে আলোচনা হয় না। যখনই কোনো গ্রাহক প্রশ্ন তুলবে যে কেন এই ডকুমেন্ট প্রয়োজন, তখনই তার সেবা আটকে যাবে। অর্থাৎ একজন সচেতন গ্রাহক হিসেবে যখনই তার অধিকার প্রয়োগ করতে যাবে, তখনই সেই গ্রাহক যে ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে শুধু সমস্যায় পড়বে তেমন নয়, কোনোরকম সেবাই হয়তো সে পাবে না।
আমার ওপরের মন্তব্যকে অনেকেই অতিরঞ্জিত ভাবতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। ধরুন, একজন গ্রাহক ব্যাংকের ইস্যু করা দশ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত বা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করতে চান। উল্লেখ্য, ব্যাংকের পরিভাষায় স্থায়ী আমানত বা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডকে ক্যাশ কোলেটারাল বলা হয়ে থাকে। প্রথমেই সেই গ্রাহককে এই ক্যাশ কোলেটারালে স্থাবর দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে ব্যাংক যখনই মনে করবে তখনই সেই গ্রাহকের জমা দেওয়া ক্যাশ কোলেটারাল ভাঙিয়ে প্রদত্ত ঋণ পরিশোধ করে ফেলতে পারবে। আরও একটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে ব্যাংক কিন্তু দশ লাখ টাকার ক্যাশ কোলেটারালের বিপরীতে দশ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করবে না। সর্বাধিক আট লাখ টাকার ঋণ প্রদান করতে পারে এবং দুই লাখ টাকার মার্জিন হাতে রাখবে কখনো প্রয়োজনে বকেয়া সুদসহ ঋণের টাকা আদায় করতে যেন কোনো সমস্যা না হয়।
আলোচ্য ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা সরিয়ে রেখে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে ক্যাশ কোলেটারালের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণের অর্থ ব্যাংক ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবে একজন গ্রাহক যখন ক্যাশ কোলেটারাল সম্পূর্ণ ডিসচার্জ করে ব্যাংকে দিয়ে দেয়, তখন সেই ঋণ গ্রহণের জন্য আর কোনো কাগজপত্র প্রদানের প্রয়োজন থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে একগুচ্ছ কাগজপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নেবে, যার মধ্যে ঋণগ্রহীতার ব্যক্তিগত নিশ্চয়তাপত্র বা পার্সোনাল গ্যারান্টি এবং চেক বইয়ের একটি খালি পাতাও থাকতে হবে। সেই ঋণগ্রহীতা যদি বলে যে আমি তো ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তাস্বরূপ পুরো ক্যাশ কোলেটারাল ডিসচার্জ করে জমা দিয়েছি, তা হলে পার্সোনাল গ্যারান্টি এবং চেক বইয়ের খালি পাতা জমা দিতে হবে কেন। তাৎক্ষণিক ব্যাংক সেই গ্রাহককে জানিয়ে দেবে যে এগুলো দিলে তার ঋণ হবে, তা না হলে নেই। তারা একবারও বোঝার চেষ্টা করবে না যে আসলে এই অতিরিক্ত ডকুমেন্টের কোনো প্রয়োজন আছে কি না।
এখন অনেক ব্যাংকার হয়তো আমার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলার চেষ্টা করবেন যে ব্যাংক এসব ডকুমেন্ট কখনোই প্রয়োগ করে না। শুধু অডিট আপত্তি থেকে বাঁচার জন্য নিয়ে থাকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে ডকুমেন্ট ব্যাংক কখনোই প্রয়োগ করবে না বলে মনে করে, সে রকম ডকুমেন্ট নিতে হবে কেন। আর এ রকম ডকুমেন্ট না নেওয়ার কারণে অডিট আপত্তিই বা উঠবে কেন। আসলে এসব হালকা কথা বলা হয় শুধু ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে যখন ব্যাংকের প্রয়োজন হয় তখন এই ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর মাঝখান থেকে বিপদে পড়ে যায় বেচারা গ্রাহক।
প্রয়োজন ব্যতিরেকে প্রদত্ত অতিরিক্ত ডকুমেন্টের অপপ্রয়োগ যে কি ভয়ংকর হতে পারে তা একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক, একজন গ্রাহক ব্যাংকে দশ লাখ টাকার ক্যাশ কোলেটারাল জমা দিয়ে তার বিপরীতে আট লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের জন্য অন্যান্য ডকুমেন্টের সঙ্গে ঋণগ্রহীতা তার পার্সোনাল গ্যারান্টি এবং চেক বইয়ের একটি পাতা কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে জমা দিয়েছে। এখন দেখা গেল সেই ঋণ হিসাব থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে পঞ্চাশ লাখ টাকার অতিরিক্ত ঋণ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক প্রথমেই জালিয়াতি স্বীকার করে তা প্রমাণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমেই এটি গ্রাহকের ঋণ হিসাব দেখাবে, ফলে সেই গ্রাহককে এই ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংক গ্রাহককে নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দিয়ে সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে বলবে। না দিলেই গ্রাহকের পার্সোনাল গ্যারান্টি প্রয়োগ করে তার অন্যান্য সম্পত্তি নিয়ে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করবে। নতুবা গ্রাহকের জমা দেওয়া ব্ল্যাংক চেক ব্যবহার করে তাকে জেলে নেওয়ার চেষ্টা করবে। সেই গ্রাহকের যদি সামর্থ্য থাকে এবং তিনি যদি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তা হলে শেষ বিচারে কী হবে তা হলফ করে বলা মুশকিল। হয়তো বিচারের রায় গ্রাহকের পক্ষে যাবে। কিন্তু ততদিনে গ্রাহক যে কী ভয়ংকর বিপদের মধ্যে থাকবে, তা ভাবতেও গা শিহরে ওঠে। অথচ এই অবস্থার সৃষ্টি হবে না, যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজপত্র, যেমন-পার্সোনাল গ্যারান্টি, ব্ল্যাংক চেক ব্যাংকে জমা দেওয়া না হয়।
এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যেখানে ব্যাংকে কাগজপত্র জমা দেওয়া নিয়ে গ্রাহকদের ভোগান্তির শেষ নেই। আবার এ কথাও ঠিক যে এই কাগজপত্র জমা দেওয়ার বিষয় নিয়েই ব্যাংকারদের কাজের সবচেয়ে অডিট আপত্তি দেখা দেয়। এসব অডিট আপত্তি ঠিক করতে ব্যাংকারদের গলদঘর্ম হতে হয়। এমনকি অডিট আপত্তির পরিমাণ বেশি হলে এবং সেগুলো সঠিকভাবে নিষ্পত্তি না হলে অনেকের পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধি স্থগিত হয়ে যায়। ফলে যেসব ব্যাংকার শাখায় এবং গ্রাহক পর্যায়ে কাজ করেন তারা থাকেন উভয় সংকটে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং প্রধান কার্যালয়ের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সব কাগজপত্র নিতে গেলে গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হয়। আবার গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করতে গেলে কাগজপত্রে ঘাটতি থাকে যার কারণে অডিট আপত্তি দেখা দেবে। বাস্তবে এই অবস্থা মোটেই হওয়ার কথা ছিল না যদি ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিস নিশ্চিত করে একটি মানসম্পন্ন ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। আমাদের ব্যাংকিং খাতে তেমনটা সেভাবে হয়ে ওঠেনি। এখন মনে হয় সময় এসেছে এদিকে নজর দেওয়ার।
বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকের মালিকপক্ষের সংগঠন, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সাধারণ এবং মানসম্পন্ন ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এখানে শুধু প্রয়োজনীয় এবং অত্যাবশ্যিক কাগজপত্র নেওয়ার বিধান রাখতে হবে। কোনোরকম অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত কাগজপত্র প্রদানের সুযোগ রাখা হবে না। ব্যাংকের কোনো সেবার জন্য কি ধরনের কাগজপত্র প্রদান করতে হবে, তার একটি সুস্পষ্ট তালিকা তৈরি করে রাখতে হবে। এই তালিকা ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিস হিসেবে গৃহীত হবে। অর্থাৎ সব ব্যাংক এই একই ধরনের কাগজপত্র গ্রহণ করবে।
আর প্রতি দুই বছর পরপর বা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ পরিবর্তনের কারণে এই ডকুমেন্টের তালিকা পুনর্বিবেচনা এবং হালনাগাদ করার বিধান থাকতে হবে। এই কাজটি করতে হবে ব্যাংকের সব সেবার ক্ষেত্রেই, কিন্তু শুরুটা করতে হবে ব্যাংকের হিসাব খোলা থেকে। কেননা হিসাব খোলার মাধ্যমে ব্যাংকের গ্রাহক হতে হয় এবং তার পরই ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ
সময়ের আলো/আরএস/