প্রেম ও দ্রোহের কবি অজানার ডাকে...
প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। বাংলা কবিতায় সৃষ্টি হলো এক চিরস্থায়ী শূন্যতার। তার কবিতা আমাদের হৃদয়ে প্রেম, বেদনা আর স্বাধীনতার গভীর অনুরণন তৈরি করেছিল। তিনি কেবল কবি ছিলেন না; ছিলেন সময়ের সাক্ষী, প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’-এই একটি লাইনই তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে আমাদের মাঝে। তার প্রতিটি শব্দ যেন রক্তে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো।
কোভিড পরবর্তী সময় থেকে শাহবাগের সুপার হোস্টেলে থাকতেন হেলাল হাফিজ। শুক্রবার সেখানে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কবির বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
গ্লুকোমায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন তিনি। পাশাপাশি কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস এবং স্নায়ু জটিলতাসহ একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল তার। হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। অকৃতদার ছিলেন তিনি।
কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে বেশি বিক্রি হওয়া কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এ পর্যন্ত ৩৩টি সংস্করণ বেরিয়েছে এ কাব্যগ্রন্থের। এটি প্রকাশের ২৬ বছর পর ২০১২ সালে তিনি ‘কবিতা ৭১’ নামের দ্বিতীয় কবিতা সংকলন প্রকাশ করেন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙ্্ক্তিটি মিছিলে, স্লোগানে এবং কবিতাপ্রেমীদের মুখে মুখে ছিল।
কবি ভেবেছিলেন পতাকা পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতায় লিখেছিলেন-
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
পতাকা পেয়েছিলেন কিন্তু সবকিছু নিয়ে যেতে পারেননি সংসারে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ যখন বাজার কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তারপর ২৬ বছর কোনো কবিতা প্রকাশ করেননি তিনি। কবিরা এমনই হন, আড়ালে থাকেন, আড়ালেই চলে যান।
হেলাল হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কারসহ অন্যান্য সম্মাননাও পেয়েছেন। তার কাজ অমর হয়ে থাকবে, অনুপ্রাণিত করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কবি ও পাঠকদের। ভালো থাকবেন কবি হেলাল হাফিজ। আমি বিশ্বাস করি, আপনি পাখি হয়েছেন।
‘ডাক দিলে’ কবিতায় আপনি লিখেছিলেন...
একবার আমন্ত্রণ পেলে
সবকিছু ফেলে
তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,
অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে
লোকালয়ে থাকবো না আর
আমরণ পাখি হয়ে যাবো, খাবো মৌনতা তোমার।
অবশেষে কবি হেলাল হাফিজ মৌনতার আমন্ত্রণ পেলেন, আমাদের মৌন করে চলে গেলেন।
কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক
শুক্রবার এক শোকবার্তায় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
প্রধান উপদেষ্টা কবির পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন তারুণ্যের শক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তার কালজয়ী কবিতার মতোই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
দাফন বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে
শনিবার বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমি এবং বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে কবি হেলাল হাফিজকে। এ তথ্য নিশ্চিত করে কবির বড় ভাই দুলাল হাফিজ শুক্রবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার রাতে মরদেহ রাখা হবে হিমঘরে।
সময়ের আলো/আরএস/