মোনা ইয়াকুবিয়ান আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব পিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এর কেমন প্রভাব পড়বে তা নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিজের একটি মতামত প্রকাশ করেন। সময়ের আলোর পাঠকের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন কৃপাসিন্ধু পাল
মোনা ইয়াকুবিয়ান আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব পিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এর কেমন প্রভাব পড়বে তা নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিজের একটি মতামত প্রকাশ করেন। সময়ের আলোর পাঠকের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন কৃপাসিন্ধু পাল।
বাশার আল আসাদের শাসনব্যবস্থার পতন কেবল সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের দশকব্যাপী শাসনের অবসান ঘটাচ্ছে না, এটি মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার পুনর্সামঞ্জস্যেরও প্রতিশ্রুতি দেয়। স্থল পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত অনিশ্চিত, বিশেষত বিদ্রোহীরা ক্ষমতা সংহত করতে পারবে কি না এবং তা পারলে তারা কীভাবে শাসন করবে এই প্রশ্নগুলো ঘিরে। কিন্তু সিরিয়ায় একটি নতুন বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ক্ষমতার গতিশীলতার একটি পুনর্বিন্যাস ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, যা ইরানের প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করছে এবং তুরস্ককে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত করছে।
সিরিয়ার প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের সময় অন্তত ছয়টি বিদেশি সামরিক বাহিনী এই সংঘাতে জড়িত ছিল, যা ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এর গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। এর মধ্যে ইরান স্পষ্টতই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে।
জানা যায়, ইরান শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে এবং হাজার হাজার প্রক্সি মিলিশিয়া যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। তেহরানের জন্য, সিরিয়া ছিল তাদের প্রতিরক্ষামূলক কৌশলের অগ্রভাগ, যা আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা এবং শক্তি ও প্রভাব বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল। আসাদের পতন এই প্রভাবকে খর্ব করছে, তেহরানকে একটি প্রধান আরব মিত্র থেকে বঞ্চিত করছে এবং তাদের লেবাননের প্রক্সি হিজবুল্লাহর সঙ্গে স্থলপথ সংযোগ ছিন্ন করছে। সিরিয়ায় কয়েক দশক ধরে থাকা তাদের কৌশলগত অবস্থান থেকে উৎখাত হওয়া, ইরানের পক্ষে শিগগিরই এই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক জটিল। এইচ.টি.এস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত, যা শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। তুরস্ক প্রকাশ্যে এইচটিএসর সঙ্গে সহযোগিতা করে না, তবে তাদের সঙ্গে নীরব যোগাযোগ এবং প্রভাব বজায় রাখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য তুরস্ক সম্ভবত এইচটিএসর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠবে, যা সিরিয়ায় তাদের প্রভাবকে গভীর করবে। তুরস্ক ইতিমধ্যেই উত্তর সিরিয়ার বেশিরভাগ অংশে একটি কার্যত বাফার জোন বজায় রাখে। তারা এই নতুন অবস্থানটি ব্যবহার করবে সিরিয়ায় কুর্দি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং প্রায় তিন মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থীর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে, যা তুরস্কের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার একটি প্রধান উৎস।
ধনী উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোও এতে লাভবান হতে পারে। আলাওয়াইট সংখ্যালঘু থেকে উঠে আসা বাশার আল আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রস্থলে সুন্নি ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটায় এবং সিরিয়া একটি নতুন উপসাগরীয় মিত্রে পরিণত হতে পারে। উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য সিরিয়ার পুনর্গঠনে অর্থায়ন করতে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা তাদের আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক একীকরণের দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করবে। একইভাবে, বাশার আল আসাদের প্রস্থান সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত থেকে উদ্ভূত মাদক পাচার, সন্ত্রাসবাদ এবং অস্ত্র চোরাচালানের মতো আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে। জিহাদি চরমপন্থার বিষয়ে সতর্ক উপসাগরীয় দেশগুলো হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) গোষ্ঠীর চরম উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারে।
ইসরাইলের জন্য সিরিয়ার নতুন বাস্তবতা মিশ্র ফলাফল বয়ে আনতে পারে। সিরিয়ায় ইরান এবং হিজবুল্লাহর হুমকি নিরসন এবং ভবিষ্যতে হিজবুল্লাহকে পুনরায় সজ্জিত করার ইরানের সক্ষমতাকে ব্যাহত করা ইসরাইলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। তবে দামেস্কে আল-কায়েদার সাবেক শাখার ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা অস্বস্তিকর এবং ইসরাইল সিরিয়ায় অস্থিরতার সময় সম্ভাব্য হুমকির বিস্তার থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। এই সম্ভাব্য হুমকির কথা মাথায় রেখে ইসরাইল ইতিমধ্যেই তার নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে: তারা গোলান হাইটসে একটি নিরস্ত্রীকৃত বাফার জোনে সেনা মোতায়েন করেছে এবং সিরিয়ার কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে রোববার দামেস্কে একটি নিরাপত্তা কমপ্লেক্স এবং একটি সরকারি গবেষণাকেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেশী লেবাননে, আসাদ-পশ্চাদবর্তী পরিবর্তনের প্রকৃতি দেশটির জন্য একটি নির্ণায়ক মুহূর্ত হয়ে দাঁড়াবে, যা হয়তো দেশটিকে বহুল আকাক্সিক্ষত সাফল্য এনে দেবে অথবা আরও গভীর সংকটে ডুবিয়ে দেবে। যদি সিরিয়ায় পরিবর্তন তুলনামূলকভাবে মসৃণভাবে ঘটে, তবে এর লেবাননে ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য হতে পারে। সিরিয়ায় আপেক্ষিক শান্তি লেবাননে বসবাসরত ১০ লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থীকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবে, যা দেশটিকে পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাশ দেবে, বিশেষত ইসরাইলের সঙ্গে এক বছরের সংঘাতের পর।
যখন সিরিয়ার পুনর্গঠন শুরু হবে, এটি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং লেবাননের ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটাতে পারে। অন্যদিকে যদি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ব্যর্থ হয় এবং পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবে লেবানন নতুন করে শরণার্থীদের ঢল দেখতে পারে, যা আরও গভীর সংকট এবং এমনকি ব্যাপক গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
সিরিয়ার কৌশলগত গুরুত্বের কারণে, শাসনের পতন বিশ্ব শক্তির ভারসাম্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। যদিও আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় রাশিয়ার অবস্থান অস্পষ্টত, বিশেষ করে রাশিয়া তার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিমান এবং নৌ-ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে কি না, রাশিয়ার সিরিয়ার মিত্রের পতন মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাবের ওপর বড় আঘাত হেনেছে। রাশিয়ার কৌশলবিদরা একসময় সিরিয়াকে রাশিয়ার প্রথম পোস্ট-সোভিয়েত সাফল্য বলে উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু মি. আসাদের পরাজয় নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরেও রাশিয়ার মর্যাদাকে দুর্বল করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া সম্ভাব্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই বয়ে আনবে।
একটি নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকের পতন, যিনি অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং ইরান ও রাশিয়ার প্রভাবের ক্ষয় নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে আল-কায়েদার সাবেক সহযোগী এবং একটি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যদি প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সম্পৃক্ত হবে এবং সবচেয়ে খারাপ ফলাফল এড়াবে, তা কঠিন সিদ্ধান্তের বিষয় হবে। এইচটিএস (হায়াত তাহরির আল-শাম) আসলেই সংযত হয়েছে কি না, যেমনটি তারা দাবি করে, তা আমেরিকার বিকল্পগুলো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এদিকে সম্ভাব্য আইএসআইএস পুনরুত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবেও দেখা দিচ্ছে।
আসাদের পতনের আনন্দ যখন সিরিয়ার জটিল বাস্তবতায় পরিণত হবে, তখন দেশের নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো আরও স্পষ্ট হতে শুরু করবে। ক্ষমতার শূন্যতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং সিরিয়ার বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি হুমকি নতুন বিশৃঙ্খলা এবং সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সিরিয়া তার দুঃস্বপ্নকে একটি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে পারে, যা তার বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং জাতিগত গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে।
যে দিকেই যাক না কেন, আসাদের পতন এবং নতুন সিরিয়ার আবির্ভাব অঞ্চলজুড়ে নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান ব্যবস্থার গঠন নির্ধারণ করবে।
আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব পিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট
সময়ের আলো/আরএস/