আরব সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র নাগিব মাহফুজ ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মিসরের এক নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম নাগিব মাহফুজ আবদেল আজিজ ইব্রাহিম আহমেদ আল-বাশা। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার এবং নাট্যকার। চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন তিনি। যদিও তার প্রধান ক্ষেত্র ছিল উপন্যাস এবং ছোটগল্প।
তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের সপ্তম এবং কনিষ্ঠ সন্তান। চার ছেলে এবং দুই মেয়ের পর নাগিবের জন্ম। অন্যান্য ভাই-বোন বয়সে তার চেয়ে বেশ বড় ছিলেন। ফলে তিনি যেন একমাত্র সন্তান এভাবেই বেড়ে উঠেছেন। তার পরিবার কায়রোর দুটি পরিচিত শহরে বসবাস করেছে। এই শহরই তার লেখার পটভূমি হিসেবে উঠে এসেছে। নাগিব মাহফুজের বাবা আবদেল আজিজ ইব্রাহিম ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী, যাকে নাগিব ‘পুরোনো আমলের মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মায়ের নাম ছিল ফাতেমা। ফাতেমা নিজে নিরক্ষর হলেও ছিলেন সংস্কৃতবান। ছেলেকে নিয়ে তিনি মিসরীয় জাদুঘর এবং পিরামিডের মতো স্থানগুলোতে অনেকবার ভ্রমণ করেছেন।
নাগিব মাহফুজের পরিবারের লোকজন ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কঠোরভাবেই পরিবারে ইসলামের নিয়মকানুন মানা হতো। একটি সাক্ষাৎকারে শৈশবে তার বাড়ির পরিবেশ-আবহাওয়া কেমন ছিল তা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি কখনো চিন্তা করতে পারবেন না, এমন এক পরিবেশ থেকে একজন শিল্পী বেরিয়ে আসতে পারে।’
১৯১৯ সালে মিসরের বিপ্লব নাগিব মাহফুজের ওপর ভীষণ প্রভাব বিস্তার করে। যদিও সে সময় তিনি ছিলেন খুবই ছোট। মাত্র সাত বছরের বালক। তারপরেও বলা যায়, এই ঘটনাই তার জীবনকে বদলে দেয়। তিনি জানালা দিয়ে দেখতে পান, ব্রিটিশ সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করছে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্যে। এই ব্যাপারটি ছোট্ট মাহফুজকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।
মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর ১৯৩০ সালে তিনি ইজিপশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। দর্শন নিয়ে এমএ-তে ভর্তি হবার পরও এক বছর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইস্তফা দেন। পেশাদার লেখক হওয়ার দিকে মনোযোগ দেন। নাগিব মাহফুজের প্রথম কাজ আল মাজাল্লা আল জাদিদা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তিনি আরিসালাহ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোন দেন। এই সময়ে তাঁর ছোটগল্পগুলো আল-হিলাল এবং আল-আহরাম পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকেন।
সাংবাদিক হিসেবে শুরু করলেও তিনি দ্রুতই তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ১৯৩৪ সালে দর্শন নিয়ে স্নাতক পাস করার পরপর মিসরীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি বিভিন্ন পদ এবং মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন।
নাগিব মাহফুজ দীর্ঘ সত্তর বছরের লেখক জীবন পেয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সত্তর বছর সাহিত্য জীবন পাওয়া ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার। এই সময়ের মধ্যে তিনি পঁয়ত্রিশটি উপন্যাস, সাড়ে তিনশ-ও বেশি ছোটগল্প, ছাব্বিশটি চিত্রনাট্য এবং পাঁচটি নাটক রচনা করেন। নাগিব মাহফুজের সবচেয়ে পরিচিত কাজ হচ্ছে ‘কায়রো ট্রিলজি।’ যেখানে তিনি নানান পরিবারের তিনটি প্রজন্মের ছবি এঁকেছেন। এই উপন্যাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৫২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে রাজাা ফারুকের পতন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কে ধারণ করেছে।
তার অনেক উপন্যাসই ধারাবাহিকভাবে আল-আহরাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ নামে একটি সাপ্তাহিক কলাম লিখতেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে তাঁর অল্প কয়েকটি উপন্যাস পশ্চিমে প্রকাশিত হয়।
তার অনেক বই-ই ‘দার-এল-মা রাফ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি তার উপন্যাসে প্রাচীন মিসরকে যেমন তুলে এনেছেন, তেমনি তুলে এনেছেন আধুনিক মিসরকেও। নাগিব মাহফুজের ‘আবাথ আল-আদার’, ‘র্যাডোপসিস, ‘কিফাহ তিবাহ’ প্রভৃতি উপন্যাসে আমরা প্রাচীন মিসর থেকে আধুনিক মিসরের বিশ্বস্ত চিত্র দেখতে পাই। নাগিব ছিলেন অকুতোভয় লেখক। তার লেখায় তিনি স্বীয় বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ফলে স্বৈরাচারী শাসক ছাড়া ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েছেন।
নাগিব মাহফুজের বয়স যখন ৮২, অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে মৌলবাদীরা ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে আহত করে। তবে থেমে থাকেনি তার কলম। তিনি তার কাজকর্ম, আড্ডা ঠিকই চালিয়ে গেছেন। ১৯৮৮ নাগিব মাহফুজ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্ববাসীর নজর শুধু তার ওপরই নয়, পুরো আরব সাহিত্যের ওপর পড়ে। পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমি বলেছে, তিনি আরব সাহিত্যে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন, তার সব মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য। নাগিব মাহফুজের উল্লেখযোগ্য বই হলো- ‘হুইসপার অব ম্যাডনেস’, ‘মকারি অব দ্য ফ্যাট’, ‘কায়রো মডার্ন’, ‘চিলড্রেন অব গেবেলাভি’, ‘দ্য থিফ এবং দ্য ডগস’, ‘অটাম কোয়েল’, ‘গড’স ওয়ার্ল্ড’, ‘দ্য সার্চ’ প্রভৃতি। নাগিব মাহফুজ ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট ৯৪ বছর বয়সে মারা যান।
সময়ের আলো/আরএস/