ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:৩২ এএম  (ভিজিট : ২৫২)
নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য নিয়ে খোদ সরকারও ক্ষুব্ধ। এই অবস্থা পতিত আওয়ামী লীগ সরকার থাকতেই শুরু হয়েছে। আওয়ামী সরকারের শেষ সময়ে একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে বাজারব্যবস্থা। সাধারণ জনগণের আয়ত্তের বাইরে চলে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। যার প্রকাশ জুলাই আন্দোলনে স্পষ্ট ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী একটি আন্দোলনের মতো সাধারণ আন্দোলনে আপামর জনতা নেমেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।

সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণেই মূলত এটি সরকার পতনের দিকে দ্রুত ধাবিত হয়। আর অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি বা অন্য কোনো কারণে নয়, কেবল নিজেদের দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার অধিকারটাই বোঝে। সেখানে আঘাত লাগাতেই আওয়ামী সরকারের পতন চেয়েছে এত ক্ষুব্ধ হয়ে। আওয়ামী সরকারের একেবারে শেষ সময় থেকে বাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত জুলাই মাসের প্রথম দিকে সংসদের অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ২ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (সংশোধন) বিল-২০২৪’ পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা অভিযোগ করেন, সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে গরিব মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যকে সহজলভ্য করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলেও তা করার ক্ষমতা তাদের নেই।

ট্যারিফ কমিশনের এক বিল পাসের আলোচনায় বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এ মন্তব্য করেন। বিলটিতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সচিব পদের নাম পরিবর্তন করে আইন সংশোধন করা হয়। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বিলটি পাসের জন্য সংসদে উপস্থাপন করেন। এরপর বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। নতুন এ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সচিব পদের নাম হবে ‘পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ)’।

বিলের ওপর সংশোধন আলোচনায় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো আইন এখনও কার্যকর করতে পারেনি। যখন তারা বাজারে যান তখন বাজারটা ঠিক থাকে। কিন্তু তারা চলে এলে আবার যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় চলে যায়। দাম দ্বিগুণ বাড়ে। সিন্ডিকেট ভাঙা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আছে বলে আমার মনে হয় না। ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা লাভ করে কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মানুষ সুচিকিৎসা পেত। আইন করে ক্যানসারের ওষুধের দাম, কিডনি চিকিৎসা কমাবার কথা বলা হচ্ছে; এ কোম্পানিগুলো কি বাইরের? এরা আমাদের দেশি মালিক, এদের কি বিবেক নেই? কত শতাংশ লাভ করছে? এরা ১০০ শতাংশ লাভ করে! যারা দোকানে বিক্রি করে ৩০-৪০ শতাংশ কর দেয়। অনেক ওষুধের মধ্যে দাম লেখা থাকে না। সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব বাজার নিয়ন্ত্রণ করুন। সংসদের সেই আলোচনার পরও বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি।

ওই সংসদের পরই দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই সুযোগে আরও অস্থির হয়ে ওঠে দ্রব্যমূল্যও। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজের মূল্য বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৭/১৮ জুলাইয়ের দিকে কাঁচা মরিচের কেজি ৪০০ থেকে স্থানভেদে ৫০০ টাকাও বিক্রি হয়েছে। পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। সবজিসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ছিল আগের মতোই।

এরপর আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মানুষ স্বস্তির আশা করেছিল। নতুন সরকারের কাছে প্রথম ও প্রধান চাওয়া ছিল বাজারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ে আসা। কিন্তু এই সরকার এসেও তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই নিত্যপণ্যের বাজারে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম অস্থিতিশীল থাকে। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার। দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। 

দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা কমানো যেত। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোরও আমদানির সক্ষমতা কমে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে ক্ষয় হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য মতে, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৭২ শতাংশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমানে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের চেয়ে বেশি। এসব গল্প আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও শোনা গেছে। দায়িত্বরতরা গণমাধ্যমের সামনে অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু দৃশ্যত কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন সবজির মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও ৮০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে কেজিদরে সবজি বিক্রি হচ্ছে। অস্থির পরিস্থিতি রয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই তিন-সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই কয়েকবারই আলাদা আলাদা পণ্য ঘিরে বাজার অস্থির হয়েছে। 

কখনো ডিম, কখনো মুরগি বা আলু-মরিচ। সবশেষ ভোজ্য তেল নিয়ে সেই পুরোনো চিত্রই দেখা গেল। ঠিক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেমন করে তেলের দাম বাড়ানোর আগে বাজার থেকে সব উধাও করে ক্রাইসিস তৈরি করা হতো। এরপর জনগণের মধ্যে একটি হাহাকার তৈরির পর দাম বাড়িয়ে বাজারে হাজির করা হলো, সেই একই ঘটনা দেখলাম সদ্য সমাপ্ত সপ্তাহে। কাট টু কাট কপি যাকে বলে আরকি। গত কয়েক দিন ধরে বাজারে ভোজ্য তেল পাওয়া যাচ্ছিল না। 

বিশেষ করে বোতলজাত সয়াবিন তেল। এরপর মানুষ বাধ্য হয়েই খোলা তেল কিনতে শুরু করল। সেটি সিন্ডিকেট সরাতে পারেনি, কারণ খোলা তেল মজুদ করলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যারা বোতলজাত তেল খেতে অভ্যস্ত তারা এক ধরনের বিপদেই পড়েছিলেন। শেষে অবস্থা এমনÑদাম যত খুশি বাড়িয়ে তেল তো দিক। ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম বাড়িয়ে দিলেন। দোহাই দিলেন আন্তর্জাতিক বাজারের। যদিও এটি মোটেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ভারসাম্য ছিল না। কে কাকে বলতে যাবে এসব কথা। বলার উপায়ই বা কী? 

নতুন দায়ত্বি পাওয়া বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনও এক ধরনের বিপদেই পড়েছেন যেন। তড়িঘড়ি করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। জানতে চাইলেন সমস্যার কথা। ব্যবসায়ীরা জানালেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এই দামে তাদের পোষাচ্ছে না। লোকসান হচ্ছে। শেষে আলোচনা করে লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়িয়ে বাজারে ফেরানো হয় বহুল কাক্সিক্ষত সয়াবিন তেল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেট সরকার কেন ভাঙতে পারছে না। সরকার পরিবর্তন হলেও কেন এদের পরিবর্তন বা সিন্ডিকেট সিস্টেমের পরিবর্তন হচ্ছে না। 

অন্তর্বর্তী সরকারের এই মুহূর্তে প্রধান কাজ হওয়া উচিত দেশের বাজারে স্বস্তি ফেরানো। আর এ জন্য সরকারের অবশ্যই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন। খাদ্যশস্যের মজুদ সক্ষমতাও বাড়তে হবে। যখন বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে, তখন যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। পরিবহন চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেমাফিক দাম বাড়িয়ে দেওয়াসহ ক্ষুদ্র বিষয়গুলোও নজরদারিতে আনতে হবে। সরকারের এতটুকু ভাবনায় রাখতেই হবে-জনগণ দুমুঠো খাবারের অধিকার চায়।


প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close