দেশ গড়ার কাজে ব্যর্থ হলে তরুণ প্রজন্ম কখনই আমাদেরকে ক্ষমা করবে না : উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার
দেশের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা অবহেলিত। নব্বই শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা বঞ্চিত। চিকিৎসার সুব্যবস্থাও তেমন নেই। এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। এছাড়াও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আহত এবং নিহত পরিবারও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) বিকালে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘মেন্টাল হেলথ ক্রাইসিস: ডিলিং উইথ পোস্ট জুলাই রেভ্যুলেশনারি আসপেক্টস’ শীর্ষক এ সেমিনারের বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, জুলাই আগষ্টের আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদের পাশে যদি আমরা না থাকতে পারি তাহলে এই সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে আমার থাকাটা অপরাধ বোধ হিসেবে কাজ করবে। যদিও না আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা না করতে পারি। আমরা ব্যর্থ হয়ে দাঁড়াবো। হয়ত সবকিছুই আমাদের সাধ্যের মধ্যে নেই তবুও যতটুকু সাহায্য করা যায় তার সবটুকু চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অন্তর্বর্তী সরকার। আন্দোলনে আহতদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ঘাটতির অভাব নেই। তাদেরকে সহযোগিতা করতে টাকা-পয়সা কোন বিষয় না। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ কোনভাবেই সম্ভব না।
তিনি বলেন, আমরা যেন বাইরের কোন শক্তি বা অপশক্তিকে ভয় পেয়ে দেশ গড়ার কাজে পিছিয়ে না যাই। আমরা যেন নিজ নিজ কর্তব্য থেকে সরে না আসি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারণ দেশ গড়ার কাজে ব্যর্থ হলে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহত কিংবা নিহতরা কিংবা তরুণ প্রজন্ম আমাদেরকে কখনই ক্ষমা করবে না।
উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অঙ্গহানির জন্য তাদের যারা তিরস্কার বা কটু কথা দ্বারা মানসিক আঘাত দেয় তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না। আমরা দেখেছি আন্দোলনের পর থেকে অনেক মা বাবারাও ট্রমাটাইজড। অনেক পরিবারের মেয়েরা আন্দোলনে ট্রমাটাইজড হয়ে লোক ভয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না এই ভয়ে যে, যদি মানুষ জেনে যায় তাহলে তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হতে পারে।
উপদেষ্টা আরোও জানান, আজ সকালে কেবিনেট মিটিংয়ে আহত ও শহীদ পরিবারে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আহতরা যে পক্ষের হোক তারা চিকিৎসা পাবেন। তবে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অর্ধেককে এখনো সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সব গুছিয়ে নিতে। আমরা নিশ্চিত করছি তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সার্বিক প্রয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হবে। কিন্তু সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে একটু সময় লাগছে। যাতে কেউ প্রশ্ন না তুলতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম. মুজাহেরুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ছাড়াও আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। তারা একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছেন না। তাদের আবারও সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরিয়ে আনতে হলে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। তারা যে মানসিক অবসাদে ভুগছেন তা কাটিয়ে উঠতে তাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহী করতে হবে এবং তারা সঠিক চিকিৎসা পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চরকির সিইও রেদওয়ান রনি জানান, আন্দোলনের তথ্য চিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন আন্দোলনের ভয়াবহতায়। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আন্দোলনকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতায় পরিকল্পনা থাকা উচিত।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড হেল্পলাইনের পরিচালক মো. মোহাইমিন চৌধুরী বলেন, আন্দোলনকলীন সময় থেকে চাইল্ড হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা বেড়ে যায়। যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে এবং এই সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তাদের অনেকেই এখন খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না, ঘুমোতে পারছে না। কারণ তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে এবং এই হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট হেল্পলাইন সহযোগিতা করবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক সেমিনার আয়োজনের প্রেক্ষাপট, মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন রিসোর্স ও তার সীমাবদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই আগস্টে কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় চৌদ্দশত তেইশ জনেরও বেশী মানুষ নিহত হয়েছে, আহতদের সংখ্যা বাইশ হাজারের ও বেশী যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর।
তিনি আরো বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম ও জটিল একটি রোগ- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যেটাকে সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয়। তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকুরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভুগতে পা, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এমন পরিস্থিতিতে মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী রয়েছেন তিন হাজারের মত নিচে। এই পেশাজীবীদের আশি শতাংশেরও বেশি শুধু ঢাকাতেই কাজ করছেন। অন্যদিকে মানসিক সমস্যা আছে এমন মানুষদের নব্বই শতাংশ চিকিৎসার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে না। একদিকে নানা কুসংস্কার বিশ্বাস অন্যদিকে সবার পক্ষে ঢাকায় এসে বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য খাতে পুরো বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ আছে মাত্র .৫ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্য দেন আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ। তিনি বলেন জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানে আহত শতকরা পঁচাত্তর ভাগ মানসিক বিষণ্ণতা ভুগছেন। অনেকে শারীরিকভাবে আহত হন নি কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর একিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তাই আজকের সেমিনারের মূল দুটি লক্ষ্য হলো- জুলাই বিপ্লবের পরে যে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং হবে সেটি মোকাবিলা করা, আঠারো কোটি মানুষের জন্য সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের কর্ম কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করা। সর্বোপরি, বাংলাদেশ ২.০ এর জন্য নতুন মেন্টাল হেলথ ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে।
অনুষ্ঠান অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নওশাদ জমির। এছাড়াও প্যানেলিস্ট হিসেবে উক্ত সেমিনারে আলোচনা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগে. জেনারেল ডা. কামরুল হাসান, ব্যবস্থাপক, মো. মোহাইমিন চৌধুরী, চাইল্ড কেয়ার হেল্পলাইন, বক্তারা জুলাই-পরবর্তী বিপ্লবী পরিস্থিতির পর আসন্ন পিটিএসডি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা, প্যারা কাউন্সিলর তৈরি করার কৌশল ও সঠিক প্যারেন্টিং কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে মতামত বিনিময় করা হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেসকল ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তাদের তালিকা তৈরি করে মানসিক সেবা প্রদান করা। আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদসকে সরকারি/বেসরকারি বাবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করা এবং অভিজ্ঞ মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি করাসহ সেমিনারে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
সময়ের আলো/জেডআই