চাঁপাইনবাবগঞ্জে নদী থেকে সেচের পানি দেওয়ার জন্য নির্মিত ড্রেন দিয়ে ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ছে অটোরাইস মিলের গরম, দুর্গন্ধযুক্ত, কুচকুচে কালো বর্ণের নোংরা বর্জ্য পানি।
প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে দিন-রাত ড্রেন দিয়ে সরাসরি ফসলি জমিতে ঢুকছে এসব বিষাক্ত পানি। এর প্রভাবে জমিতে জমে থাকা পচা পানিতে নুয়ে পড়ছে জমির ধান। একদিকে ফলনহীন হয়ে পড়ছে ধানের জমি, অন্যদিকে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে পোকামাকড়ের আক্রমণ। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, সমস্যা নিরসনে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর ও কৃষি বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, অটোরাইস মিল মালিকরা নোংরা পানি ফসলি জমিতে ছেড়ে দিয়ে কৃষকদের ক্ষতি করতে পারে না। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিয়ে অটোরাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
পরিবেশ অধিদফতর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবু সাইদ সময়ের আলোকে বলেন, রাইস মিলের নোংরা পানি বাইরে ফেলার নিয়ম নেই। তারপরও এসব দূষিত পানি ফসলি জমিতে ফেলার কারণে কৃষকদের ক্ষতি হচ্ছে। সরেজমিন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ অধিদফতর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবু সাইদ আরও বলেন, অটোরাইস মিলের মালিকরা এমনটা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যে বা যারাই এটা করুক না কেন সেটা ঠিক হচ্ছে না। মিলের ভেতরে পুকুর কেটে রাইস মিলের দূষিত পানি রাখতে হবে।
এদিকে এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে জেলা মিল মালিক ও আতব ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতি এবং চালকল মালিক গ্রুপের কেউই কথা বলতে রাজি হননি।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিতে জমে থাকা বিষাক্ত পানির প্রভাব থেকে ধান রক্ষায় অনেক বেশি সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে খরচ বাড়ছে কয়েকগুণ। অনেকেই ঋণ করে ধানের চাষাবাদ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা না হলে উৎপাদন খরচই ওঠাতে পারবেন না তারা। এতে করে চরম বিপাকে পড়তে হবে স্থানীয় কৃষকদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অটোরাইস মিলের ধান সেদ্ধ ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা দুর্গন্ধযুক্ত, নোংরা ও কালো পানিতে নষ্ট হচ্ছে কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি। ঋণ করে ধান চাষাবাদ করে বিপাকে পড়েছেন সদর উপজেলার আতাহার, বুলনপুর, রাঁধুনীডাঙ্গা, বাইল্যাকান্দা মাঠের চাষিরা। কোথাও ফলন নেমেছে অর্ধেকে, আবার কোথাও শুধু খড় পাচ্ছেন কৃষকরা। প্রতিবাদ করলে উল্টো মামলা ও হামলার হুমকি দেওয়া হয়।
কথা হয় স্থানীয় কৃষক তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, গত ৬-৭ বছর ধরে এমন অবস্থা চলে আসছে। অটোরাইস মিলের কেমিক্যালযুক্ত নোংরা সব পানি ছেড়ে দেওয়া হয় ধানের সেচ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত ড্রেনে। এসব পানি মিল থেকে সরাসরি এসে পড়ে ধানের জমিতে। এতে ধানের ফলন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। উল্টো নোংরা পানির কারণে চাষাবাদের খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। অন্যের জমি চাষাবাদ করে যে খরচ হচ্ছে জমিতে তার কোনো অংশই বাড়িতে তুলতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কৃষক বলেন, এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করলেই দেওয়া হয় হুমকি ও মামলার ভয়। কারণ মিল মালিকরা বড় বড় ব্যবসায়ী। তাদের অর্থবিত্তের কাছে আমরা অসহায়। আতাহার এলাকার আরেক কৃষক আবদুল খালেক বলেন, হাজার হাজার বিঘা জমি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর ও কৃষি বিভাগ। কারণ তারাও ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলাজুড়ে অর্ধশতাধিক অটোরাইস মিল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০টি মিল রয়েছে আতাহার-বুলনপুর এলাকায়। এবার আমন মৌসুমে জেলায় ৫৪ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষাবাদ হয়েছে।
সময়ের আলো/আরএস/