ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
আমলারা এখন বিভিন্ন পরিচয়ে মানুষের সামনে হাজির হন, যা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে যে আমলা, কাল তিনিই রাজনীতিবিদ, পরের দিন তিনিই ব্যবসায়ী বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুশাসনের আকাক্সক্ষার জন্য জনকেন্দ্রিক সংস্কার’ শীর্ষক নাগরিক সম্মেলন-২০২৪-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, যে বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা আগের সরকারকে ফেলে দিলাম, সেই বৈষম্যবিরোধী চেতনার মূল মর্মবস্তুকে আমাদের ধারণ করতে হবে। আমরা লক্ষ করছি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পক্ষের শক্তির ভেতরে কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। এভাবে বৈষম্যবিরোধী চেতনার মূল তাৎপর্য তারা ক্ষুণ্ন করছে। যারা অনেক সময় বাহ্যত বৈষম্যবিরোধী কথা বলেই কিন্তু এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আছে।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের কাছে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, কে বেশি ক্ষমতাধর- আমলা, রাজনীতিবিদ নাকি ব্যবসায়ী। এ প্রশ্নের জবাবে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, ‘আমলারা’।
এ সময় তিনি বলেন, আমরা সারা বাংলাদেশ ঘুরে আলোচনা করেছি। সেসব আলোচনায় আমলাদের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। অনেক ক্ষেত্রে এই তিন পরিচয় একই ব্যক্তির হয়ে গেছে।
সম্মেলনে ড. দেবপ্রিয় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, স্বাধীন স্থানীয় সরকার কমিশন হলে সাধারণ অজুহাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের সংস্কৃতি রোধ করা যায় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া যায়। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি প্রতীক ব্যবহারের বিধান প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, একটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর এই সরকারকে বসানো হয়েছে। এই সরকার বৈষম্যবিরোধী অবস্থান কেন নেবে না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। আমাদের চাহিদার বৈচিত্র্য থাকবে, এটা স্বীকার করবে না সেটা তো হতে পারে না।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের নির্বাচনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনোনয়ন বাণিজ্য। আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো যখন দেব, সুপারিশগুলো দেব তখন সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। আমরা আশা করব, এ নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, সংসদে সংরক্ষিত আসতে থাকতে হবে। তবে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ তরুণ ও ৩০ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংষ্কার কমিশনের প্রধান বলেন, তাদের মনোভাব-কেষ্ট বেটাই চোর। তারা বলেছেন, ওপর থেকেই সব সিদ্ধান্ত হয়েছে, পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, আমাদের কী করার আছে? তার মানে ওনাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এসব কথা যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলেন তা হলে কী হবে, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত সরকারের সময়ে কর্তৃত্ববাদ বিকাশের মূল কারণ ছিল দুর্নীতি। দুর্নীতি করতে হবে, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে হবে এবং সেগুলো করে বিচারহীনতা ভোগ করতে হবে, সে জন্য রাষ্ট্রকাঠামো দখল করতে হবে। দুদকসহ সব প্রতিষ্ঠান দখল করতে হবে।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, তাদের কার্যকলাপ বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থী। আমরা সব কর্তৃত্ববাদ বর্জন করব বলছি সবাই, কিন্তু কর্তৃত্ববাদের চর্চাটা বর্জন করছি না। এ সময় সংসদে তরুণ প্রতিনিধিত্ব ও একই পেশার ২৫ শতাংশের বেশি প্রতিনিধি না থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকার নয়। তাদের ক্ষমতার ভিত্তি নেই। নির্বাচিত সরকার মানে কী, জনগণের ভোটে রায়ে নির্বাচিত সরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকারের রায় কে দিয়েছে? কে বসিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায়? জনগণ। যে ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারকে দেওয়া হয়েছে, এটা অভূতপূর্ব। আমি মনে করি, এটা কোনো নির্বাচিত সরকারেরও নেই।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শিক্ষা কমিশন হয় নেই, যেটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল ক্ষেত্র ছিল। যারা জুলাই আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তাদের সরিয়ে দিয়ে কমিশন বাতিল করা হয়েছে।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির আরেক সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ইউএনডিপি বাংলাদেশের ডেপুটি রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ সোনালি দয়ারত্নে প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ৮ ও ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), বাংলাদেশ এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) সহযোগিতায় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সময়ের আলো/জেডআই