বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই একটা অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতার জন্য কে বা কারা দায়ী তা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে এই অস্থিরতার কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। তারা না পারছে শান্তিতে কাজকর্ম করতে না দিনাতিপাত করতে।
এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে-এটাই সর্বকালীন নিয়ম। বর্তমানে কেন যেন এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে। কোনো কোনো দেশ কোনো কোনো দেশের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। কারণে-অকারণে এক প্রতিবেশী দেশ আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী মনোভাব দেখাচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের যেমন সম্পর্ক থাকার কথা তেমন সম্পর্ক না থাকলে দুই দেশের জন্যই অস্বস্তিকর। কোনো না কোনো ভাবে দেশ দুটিরই ক্ষতি হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার স্থানটাতে ব্যাঘাত ঘটে। নাগরিকদের মনের শান্তি চলে যায়। একটা অস্থিরতা কাজ করে। স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। অজানা একটা আশঙ্কা, আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার। এই দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা প্রতিবেশী দেশগুলোকে মোকাবিলা করতে হয়নি। অতীতে বেশ কয়েকবার সীমান্ত সমস্যা হয়েছে। দুই দেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় তার সমাধানও হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কিছুটা বৈরিতা হয়েছে আবার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিতও হয়েছে।
দুটি থালা-বাসন একসঙ্গে থাকলে যেমন ঠুকঠাক লাগে তেমনি দুটি প্রতিবেশী দেশের মাঝেও ঠুকঠাক লাগে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বর্তমানে যা হচ্ছে তা স্বাভাবিকতার মাত্রাকে কিছুটা অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে কূটনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা। এক দেশ আরেক দেশেকে আকারে-ইঙ্গিতে কিংবা সরাসরি অসম্মান করা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। এক দেশ আরেক দেশকে গালমন্দ করাও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বরখেলাপ। মধুর সম্পর্কের ওপর কালিমা লেপনের নামান্তর।
প্রকাশ্যে যখন একটা দেশ আরেকটা দেশকে গালমন্দ করে তখন স্বাভাবিক নিয়মে ধরে নিতে হবে যে দেশ দুটির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপন তখন অতীব জরুরি হয়ে পড়ে।
বিশ্বের মানুষ জানার বা বোঝার আগেই সম্পর্কটা পুনঃস্থাপন করা বুদ্ধিমানের কাজ। সারা বিশ্ব যদি জেনে যায় যে অমুক দেশের সঙ্গে তমুক দেশের সম্পর্ক ভালো না তখন একটা বিরোপ প্রভাব পড়ে ওই দেশ বা দেশ দুটির মানুষের ওপর। মনের ওপর বিরূপ প্রভাবের প্রতিক্রিয়াটা হয় ভয়াবহ। জীবনের শান্তি বিনষ্ট হয়।
একটা দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সুসম্পর্ক থাকলে সেসব দেশের মানুষের মনের প্রশান্তিটা থাকে আকাশ ছোঁয়া। পৃথিবীতে মানুষ তখন মানুষের মতো বাঁচতে পারে। নিজেকে অন্য গ্রহের মানুষ মনে হয় না।
একটা সময় ছিল যখন সারা বিশ্বকে একটা দেশ ভাবা হতো। মানুষ তখন ছিল পরম শান্তিতে। গাছের ফলমূল খেত, ডালপালা, লতাপাতা দিয়ে পোশাক বানিয়ে পরিধান করত। গোটা পৃথিবীর মানুষ ছিল এক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। সবাই নিজেদের ভাবত এক সমাজ এক দেশ এক গোত্রের মানুষ হিসেবে।
সেই সময়টা ছিল পৃথিবীর মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। এখনও কোনো কোনো দেশ সে রকম সময় পাড় করছে। গুটিকয়েক দেশের অশান্ত পরিস্থিতি বাদ দিলে বাকি বিশ্ব বেশ ভালো আছে। বাংলাদেশও একসময় ছিল বেশ। কী কারণে যেন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলার সোনার মানুষগুলো একটু দুশ্চিন্তায় জীবন কাটাচ্ছে। হয়তো সময়টা এই রকম থাকবে না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। বন্ধুসুলভ আচরণটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। একটু সময়ের ব্যাপার এই যা।
একটা দেশ জাতি কিংবা মানুষ যখন আরেকটা দেশ জাতি কিংবা মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে ঠিক তখনই জাতিতে জাতিতে সমাজে সমাজে দেশে দেশে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়।
ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব বলে একটা ব্যাপার আছে। কেউ যখন কারও ব্যক্তিত্বে আঘাত হানে তখনই শুরু হয় সংঘাত। একটা দেশ যখন আরেকটা দেশকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে বা হেয়প্রতিপন্ন করে তখনই শুরু হয় সংঘাত-সংঘর্ষ।
দীর্ঘদিন ধরে যখন একটা মানুষ সমাজ বা দেশ আরেকটা মানুষ সমাজ বা দেশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে বা নীচচোখে দেখে তখনই যত সমস্যা। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে প্রায় সময়ই এহেন আচরণ পেয়েছে এবং নীরবে সহ্য করেছে।
পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে মানুষ সামনে ছুটে চলে। বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা সেই রকম। এখন সামনে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সামনে যাওয়ার চিন্তা যেই করছে সেই লেগে যাচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। নানাভাবে এক দেশ আরেক দেশকে হেয়প্রতিপন্ন করার ফলাফল এমনি হয়।
একটা দেশ আরেকটা দেশকে সম্মান দেখালে, শ্রদ্ধা করলে অঘটন ঘটার আশঙ্কা কম থাকে। এক দেশ যখন আরেক দেশের ওপর কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা করে তখনই শুরু হয় ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলাফল হয় ভয়াবহ।
কারণ মানষের ধৈর্যের একটা সীমা থকে। সীমা ছাড়িয়ে গেলে কে ছোট কে বড় দেখার সময়- সুযোগ কোনোটাই থাকে না।
আমিই সবচেয়ে বড় এই মনোভাবটাই খারাপ। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল কারণও এই ‘আমি বড়’ ভাবটা। কথাটা ব্যক্তি এবং দেশে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো দেশ যখন সবসময় ‘আমি বড়’ একটা ভাব নিয়ে ছোট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সিংহসুলভ আচরণ করে তখনই সমস্যার জন্ম হয়। এই সমস্যাটা স্থায়ী হয় বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ।
বর্তমান বিশ্বে অস্থিরতার মূলেও এই ‘আমি বড়’ ভাব এবং প্রতিবেশী দেশকে ছোট করে দেখার প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের দেশের শান্তি এবং প্রতিবেশী দেশের শান্তির জন্য এর বিকল্প কিছু নেই।
বড় দেশগুলো যখন নিজেদের বড়ত্ব দেখাতে চায় তখন ছোট দেশগুলো প্রাথমিকভাবে নিজেকে দুর্বল ভাবে। পরক্ষণই আবার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সামনে পা বাড়ায়। ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলে। তখনই শুরু হয় সংঘাত। ঘাত-প্রতিঘাত। বিশ্ব হয়ে পড়ে অস্থির। মানুষের শান্তি বিনষ্ট হয়। মানুষ নিজেদের ভাবতে থাকে ভিন গ্রহের মানুষ হিসেবে।
এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা বিশ্ব নেতারা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। তত তাড়াতাড়িই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো ধর্ম-গোত্র কিংবা সমাজের মানুষ এক না হয়ে এক হতে হবে বিশ্বের মানুষকে, বিশ্বমানবতাকে। তা হলেই শান্তি আসবে।
শান্তির শুভ্র পতাকা হাতে মানুষ গোটা বিশ্ব পরিভ্রমণ করতে পারবে। এমন একটা বিশ্ব মানুষের প্রত্যাশা যে বিশ্বে কোনো হানাহানি দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে না। থাকবে না কোনো মারামারি কাটাকাটি। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের থাকবে সুসম্পর্ক। এক প্রতিবেশী দেশ আরেক প্রতিবেশী দেশের সময়ে-দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবে। তখনই জয় হবে বিশ্ব মানবতার, বিশ্ব মানবিকতার।
গোটা বিশ্বের মানুষ তখন বলবে আমি বিজয় দেখেছি, মানবতার বিজয়। সেই বিজয়ের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে গোটা বিশ্বের মানুষ। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে যে কদিন বাঁচবে সে কদিন যেন শান্তিতে বাঁচতে পারে সে প্রত্যাশা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের, প্রায় সব মানুষের। সেই প্রত্যাশার কপালে যারা আগুন লাগাচ্ছে তাদের কপাল পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার প্রার্থনা সেসব কপালপুড়া মানুষ করতেই পারে। কোটি মানুষের প্রার্থনা মঞ্জুর করার জন্য উপরে একজন আছেন। বর্তমানে মানুষের সব চাওয়া-পাওয়া সেই উপরওয়ালার কাছেই। কারণ মানুষ বোঝে গেছে অন্য কারও কাছে কোনো কিছু চেয়ে কোনো লাভ নেই। পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক। গোটা বিশ্বের মানুষ বিচরণ করুক সুখের রাজ্যে। বিশ্ব শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা নীল আকাশে ডানামেলে উড়াল দিক অবিরত। বিশ্ববিবেক জাগ্রত হোক। জয় হোক বিশ্ব শান্তির। জয় হোক বিশ্ব মানবতার। বিশ্ব মানবিকতার।
প্রাবন্ধিক
সময়ের আলো/আরএস/