
মানুষ পৃথিবীতে যা কিছু করে, সবকিছু সেই আমলনামায় লিপিবদ্ধ থাকে। ছোট-বড়, ভালো-মন্দ, প্রকাশ্য-গোপন-সব ধরনের আমলের বর্ণনা সেই আমলনামায় দেখতে পাবে পরকালে।
দুনিয়ায় যারা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখেনি, হিসাব-নিকাশ ও জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাস করেনি, আমলনামায় জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দেখে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সেই অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, ‘আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদের ভীতসন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে-হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সুরা কাহাফ : ৪৯)
নেককার লোকজন ডান হাতে আমলনামা পাবেন। আর বদকার লোকদের আমলনামা পেছন দিক থেকে বাম হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। ডান হাতে আমলনামা পেয়ে ঈমানদারগণ উচ্ছ্বসিত হবেন। আনন্দের অতিশায্যে অন্যদের ডেকে ডেকে আমলনামা দেখাবেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘যাকে আমলনামা দেওয়া হবে তার ডান হাতে, সে বলবে, হে লোকজন! এই যে আমার আমলনামা তোমরা পড়ে দেখো; আমি আগেই বিশ্বাস করেছিলাম আমাকে অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে’ (সুরা হাক্কাহ : ১৯-২০)। আর বদকাররা বাম হাতে আমলনামা পেয়ে মৃত্যু কামনা করবে। জীবন বিনাশ করে ফেলতে চাইবে। দুনিয়ার রাজত্ব ধন-সম্পদ আর বিশাল প্রভাব প্রতিপত্তির কথা স্মরণ করে বিলাপ করবে। কিন্তু সেদিন না জীবননাশের সুযোগ থাকবে, না কারও মৃত্যু হবে। সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘আর সেই ব্যক্তি, যার আমলনামা দেওয়া হবে বাম হাতে সে বলবে, হায়! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হতো! আমি যদি জানতেই না পারতাম আমার হিসাব কী? হায়! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত। আমার অর্থ সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না। আমার থেকে আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেছে!’ (সুরা হাক্কাহ : ২৫-২৯)
এই আফসোসের সময়েই আল্লাহ তায়ালার কঠিন হুংকার ভেসে আসবে-‘পাপাচারীদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।’ আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন, ‘ধরো ওকে এবং গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। তারপর তাকে এমন শিকলে গেঁথে দাও যার পরিমাণ হবে সত্তর হাত। সে মহান আল্লাহর ওপর ঈমান রাখত না’ (সুরা হাক্কাহ : ৩০-৩৩)। অপরদিকে জান্নাতিদের জন্য থাকবে আনন্দের জীবন। তারা পরিতৃপ্তির জীবন লাভ করবে। কুরআনে এসেছে, ‘সুতরাং সে থাকবে মনোরম জীবনানন্দে। সেই সমুন্নত জান্নাতে যার ফল ঝুঁকে থাকবে। (জান্নাতিদের বলা হবে) তোমরা বিগত দিনগুলোতে যে কাজ করেছিলে তার বিনিময়ে খাও ও পান করো সানন্দে।’ (সুরা হাক্কাহ : ২১-২৪)
সেদিন আমলনামা প্রদানের সময় ভালো মানুষদের অবস্থা সব দিক থেকেই ভালো হবে। আর খারাপ মানুষদের অবস্থা সব দিক থেকেই খারাপ হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাশরের মাঠে এক ব্যক্তিকে ডাকা হবে। অতঃপর তার আমলনামা প্রদান করা হবে ডান দিক দিয়ে। তার শরীর হবে ষাট হাত দীর্ঘ, চেহারা হবে উজ্জ্বল, তার মাথায় থাকবে মণিমুক্তা খচিত মুকুট যা ঝলমল করতে থাকবে; এভাবে সে তার স্বজনদের কাছে ফিরে যাবে। সবাই তখন বলতে থাকবে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকেও এমন আমলনামা প্রদান করুন, এতে আমাদের জন্য বরকত দান করুন।
আর কাফের ও অবিশ্বাসী ব্যক্তিদেরও এভাবে আমলনামা প্রদান করা হবে যে, তার শরীর ষাট হাত দীর্ঘ, চেহারা কালো হয়ে গেছে, মাথায় আগুনের টুপি পরানো; তার আত্মীয়-স্বজন এই অবস্থা দেখে বলবে, হে আল্লাহ! আমরা এ থেকে পানাহ চাই, হে আল্লাহ! আমাদের এমন পরিণাম দিয়েন না। হে আল্লাহ! একে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিন’ (তিরমিজি : ৩১৩৬; ইবনে হিব্বান : ৭৩৪৯)! তাই আমাদের কর্তব্য পরকালের সেই সুখময় জীবনের কথা স্মরণ করে এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া-আমরা কি সৎকর্মশীলদের দলভুক্ত হব না অপরাধীদের! আমরা যেন এখন থেকেই সৎকর্ম সম্পাদন করে চিরস্থায়ী সুখের স্থান জান্নাত লাভ করতে পারি; আল্লাহর কাছে এটাই একান্ত প্রার্থনা।
জাহান্নামে পাপিষ্ঠদের সব থেকে বড় কষ্ট হবে যে, তাদের সামনেই জান্নাত বিদ্যমান থাকবে যেখানে তাদের অনেক পরিচিত আত্মীয়স্বজন থাকবে। মা-বাবা জান্নাতে যাবে, ছেলেমেয়ে থাকবে জাহান্নামে। কারও বাবা-মা জাহান্নামে যাবে, সন্তানরা জান্নাতে যাবে। স্ত্রী জান্নাতে যাবে, স্বামী যাবে জাহান্নামে। স্বামী যাবে জান্নাতে, স্ত্রী যাবে জাহান্নামে। কর্মচারী যাবে জান্নাতে, বস যাবে জাহান্নামে। এমতাবস্থায় যখন প্রত্যেকে জাহান্নাম থেকে তার অপর সাথিকে জান্নাতে দেখবে তখন তাদের পরিতাপের অন্ত থাকবে না। এমনকি জাহান্নামিরা জান্নাতিদের ডেকে সামান্য পানি চাইবে। একফোঁটা পানি কামনা করবে। সেই দৃশ্যের বিবরণ দিয়ে কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জাহান্নামিরা জান্নাতিদের ডেকে বলবে, আমাদের ওপর সামান্য পানি নিক্ষেপ করো অথবা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের যে রিজিক দিয়েছেন, তা থেকেই কিছু দাও। তারা উত্তরে বলবে, আল্লাহ এই উভয় বস্তু কাফেরদের জন্য হারাম করেছেন।’ (সুরা আরাফ : ৫০)
আহ! কতইনা দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তখন। যাদের সুখের জন্য দুনিয়ায় ন্যায়-অন্যায় বাছ-বিচার করেনি এমন কঠিন মুহূর্তে তাদের থেকে এমন প্রত্যাখ্যাত হলে কষ্টের পারদ কতটা বাড়িয়ে দেবে তা বলাই বাহুল্য! এ জন্য একটি কথা খুব ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার, দুনিয়ায় যে যতই প্রিয় হোক, যে যতই ভালোবাসার পাত্র হোক- আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে তাদের খুশি করা চূড়ান্ত বোকামির কাজ। তাই ভেবে দেখুন, আপনি কার সন্তুষ্টির জন্য অবৈধ উপার্জন করছেন! কার সুখের জন্য আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হচ্ছেন! সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি আছে কি না দেখা। আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকলে সে কাজ করা, আল্লাহর অসন্তুষ্টি থাকলে পরিত্যাগ করা।
দুনিয়াতে যারা মুমিনদের নিয়ে উপহাস করেছিল, বিদ্রূপ করেছিল, পরকালে তারা যখন জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে তখন তাদেরকে ডেকে মুমিনগণ বিদ্রূপ করবেন। জান্নাতিরা জাহান্নামিদের ডেকে বলবে-‘আমাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিপালক যে ওয়াদা করেছিলেন তা আমরা সত্য পেয়েছি। অতএব তোমরা কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা সত্য পেয়েছ? তারা (হতাশ গলায়) বলবে, হ্যাঁ হ্যাঁ; পেয়েছি! অতঃপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবে-আল্লাহর অভিশাপ জালেমদের ওপর’ (সুরা আরাফ : ৪৪)। পরকালে ডান হাতে আমলনামা পাওয়ার জন্য দুনিয়ার জীবনে সর্বদা নেক আমলে মশগুল থাকার কোনো বিকল্প নেই।
সময়ের আলো/আরএস/