সকালবেলা খোকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শুনছিল। ছোট্ট মনে কৌতূহল-পাখিরা কীভাবে এত স্বাধীনভাবে আকাশে উড়ে বেড়ায়? গুনগুন করে সে বলে উঠল, ‘পাখি, তুমি কি লাল-সবুজের পাখি? তুমি কি জানো আমাদের বাংলাদেশের গল্প?’
খোকার এই কথা শুনে মা এগিয়ে এলেন। খোকাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি লাল সবুজের পাখির কথা জানতে চাও? তবে শোনো, এটা কেবল পাখির গল্প নয়, এটি আমাদের দেশের গল্প, আমাদের বিজয়ের গল্প।’
মায়ের কথা শুনে খোকা খুব আগ্রহ নিয়ে বসে পড়ল। মা বলতে শুরু করলেন, ‘অনেক দিন আগের কথা। তখন আমাদের এই বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল না। শাসকরা আমাদের ওপর অন্যায় করত। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি-সব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। মানুষ তখন কষ্টে দিন কাটাত। কিন্তু তারা মনের ভেতর সাহস আর আশার আলো ধরে রেখেছিল। কেউ হার মানেনি। তারা লড়াই করেছে নিজেদের অধিকার আর স্বাধীনতার জন্য।’
খোকা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, তারা কীভাবে লড়াই করেছিল?’
মা বললেন, ‘লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল ভাষার জন্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, আমাদের ভাষার জন্য অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। তাদের রক্তে রাঙা হয়েছিল পথঘাট। এরপর ১৯৭১ সালে এলো আরও বড় লড়াই-এবার তারা চাইল স্বাধীন দেশ। তারা চাইল নিজেদের পতাকা, নিজেদের মানচিত্র।’
খোকা বলল, ‘মা, এই লড়াইয়ে কি সবাই অংশ নিয়েছিল?’
মা মৃদু হাসলেন। ‘হ্যাঁ খোকা, সবাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক-সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ ছিল ন্যায় আর অন্যায়ের লড়াই। তারা বুঝেছিল, স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ দরকার। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলেছিল যুদ্ধ। আমাদের দেশের মাটি রক্তে ভিজে গিয়েছিল। কেউ বাবা হারিয়েছে, কেউ ভাই। কিন্তু তবুও কেউ পিছু হটেনি।’
খোকা আবার বলল, ‘তা হলে আমরা কীভাবে বিজয় পেলাম, মা?’
মা গভীর গলায় বললেন, ‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এই দিনটি আমাদের জন্য সবচেয়ে গৌরবের। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আর জনগণের একতার ফলে আমরা বিজয় পেলাম। আমরা পেলাম স্বাধীন দেশ। আমাদের হাতে এলো লাল সবুজের পতাকা। এই পতাকা মানে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের গর্ব।’
খোকা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘মা, লাল বৃত্তটা কী বোঝায়?’
মা চোখের কোণে জল নিয়ে বললেন, ‘লাল বৃত্ত মানে আমাদের শহিদদের রক্ত। যারা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের জন্য এই স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছে। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা খুব দামি, খুব মূল্যবান।’
খোকা একমনে শুনছিল। তারপর বলল, ‘মা, পাখিরাও কি স্বাধীনতার গান গাইত?’
মা হেসে বললেন, ‘পাখিরাও স্বাধীনতা চায়। খাঁচায় বন্দি করলে তারা গান গায় না। আমাদের দেশও একসময় খাঁচার মতো বন্দি ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সেই খাঁচা ভেঙে দিল। এখন আমাদের দেশ স্বাধীন, আর পাখিরাও খুশি মনে আকাশে উড়ে বেড়ায়। ঠিক লাল সবুজের পাখির মতো।’
খোকা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘তা হলে আমিও লাল সবুজের পাখি হব, মা। আমি বড় হয়ে আমাদের দেশের জন্য গাছ লাগাব, যাতে সব পাখি খুশি মনে উড়ে বেড়ায়। আর আমাদের দেশ আরও সবুজ হয়ে যায়।’
মা খোকাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি যদি এমন ভাব, তা হলে একদিন আমাদের দেশ সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ হয়ে উঠবে। তোমাদের মতো শিশুরাই তো এই দেশের ভবিষ্যৎ।
গল্প শেষ করে মা দেখলেন, খোকা নিজের ছবি আঁকার খাতা নিয়ে বসে পড়েছে। সে আঁকছে লাল-সবুজের একটি পাখি। পাখিটির ডানায় সে লিখল ‘স্বাধীনতা’। তার নিচে লিখল, ‘আমাদের বিজয় দিবস, আমাদের গর্ব।
সেই দিন থেকে খোকা সবাইকে বলতে শুরু করল, ‘লাল সবুজের পাখি শুধু একটি গল্প নয়। এটি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। আমাদের দেশের প্রতিটি শিশু, প্রতিটি মানুষ এই লাল সবুজের পাখি। আমরা সবাই মিলে দেশকে ভালোবাসব, রক্ষা করব, আর আরও সুন্দর করে তুলব।’
খোকার চোখে তখন এক নতুন স্বপ্ন। এই স্বপ্নেই সে একদিন বড় হবে, দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, আর গাইবে লাল-সবুজের পাখির গান।
সময়ের আলো/আরএস/