প্রারম্ভিককাল থেকেই বাংলা উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে সংকট ও সংগ্রাম থেকে প্রান্তিক মানুষ আত্মনির্মাণের শক্তি অর্জন করেছে সমকালীন উপন্যাসে। বাংলা উপন্যাসের প্রথম পর্যায়ে প্রান্তিক মানুষ মুখ্য চরিত্র হয়ে ওঠেনি। সে সময়ের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষ এসেছে সহায়ক ও গৌণ চরিত্র হিসেবে।
হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স ও প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁদের লেখায় প্রান্তিক মানুষকে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে উপস্থাপন করেছেন। তাদের এ উপস্থাপন ছিল আদর্শিক ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই সেখানে প্রান্তিক মানুষ সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠতে পারেনি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষকে এনেছেন সহায়ক চরিত্র হিসেবে। শরৎচন্দ্র প্রান্তিক মানুষকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করেছেন; কিন্তু সংগ্রামী করে তুলতে পারেননি। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষ মানবিক, দরদি, পরোপকারী ও আপসকামী। কিন্তু তারা সংকট ও সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মনির্মাণের শক্তি অর্জনে ব্যর্থ।
প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামীচেতনা লক্ষ করা যায় আরও পরে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষই মুখ্য ও অপরিহার্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মানিক মার্কসীয় শ্রেণিচেতনা থেকে প্রান্তিক মানুষের জীবনসংকট ও জীবনসংগ্রামের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ফলে মানিকের প্রান্তিক চরিত্ররা সংকট থেকে সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় এবং সংগ্রামে জয় কিংবা পরাজয়- যা-ই ঘটুক না কেন- তারা নতুন করে আত্মনির্মাণের দিকে এগিয়ে যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের এই আত্মনির্মাণ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই তাদের যাপিত জীবনের নানামাত্রিক সংকট ও সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তাদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। কারণ সংকট ও সংগ্রাম থেকেই আত্মনির্মাণের গতিপথ তৈরি হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের সংকটকে নানা মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। প্রান্তিক মানুষের জাতি-বর্ণ পরিচয়, ধর্ম-পরিচয় ও পেশা-পরিচয় মূলধারার মানুষের কাছে সম্মানজনক নয়। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় একসময় জাতি-বর্ণের পরিচয় দ্বারাই নির্ধারণ করা হতো ব্যক্তি সামাজিক মর্যাদা। এখনও সে মনোভাব একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। মানিকের উপন্যাসে দেখা যায় নিচু জাতের দোহাই দিয়ে মূলধারার মানুষ প্রান্তিক মানুষকে অবহেলা ও ঘৃণা করে। প্রান্তিক মানুষের ধর্ম-পরিচয় তাদেরকে মর্যাদাশীল করতে পারে না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষেরা বর্ণহিন্দুদের দুর্গাপূজার মতো ব্যয়বহুল ধর্মীয় আচার পালন করতে পারে না। গঙ্গাপূজা, মনসাপূজা, চৈত্রসংক্রান্তি- এসব উৎসব তারা ধর্মীয় মর্যাদায় পালন করে।
পেশা-পরিচয়ের ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষ মর্যাদার অধিকারী নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বংশীয় পেশা বা কুলবৃত্তি অবলম্বন করে চলে। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে অনেকে বংশীয় পেশা ছেড়ে কোনো সম্মানজনক পেশা গ্রহণ করার চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টাও তাদের আত্মনির্মাণের অংশ। এই যে জাতি-বর্ণ পরিচয়, ধর্ম-পরিচয় ও পেশা-পরিচয়ের সংকট- এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রান্তিক মানুষ কখনো ব্যক্তিপর্যায় থেকে, কখনো গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ সংগ্রামে প্রান্তিক মানুষের পরাজয় নিশ্চিত।
তবে এ পরাজয়কেও মানিক আত্মনির্মাণের পথ হিসেবে দেখিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের আরো কিছু সংকট লক্ষ করা যায়। এ সংকটগুলো সামাজিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন- অস্পৃশ্যতা, বৈধব্য, ব্যভিচার, সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, বৈষম্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি। এই সংকটগুলো কখনো সামাজিক, কখনো অর্থনৈতিক আবার কখনো মনোজাগতিক। নর-নারীর মনো-দৈহিক সম্পর্কের চিরন্তন রূপটিকে মানিক একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তাঁর উপন্যাসে। হত-দরিদ্র প্রান্তিক মানুষকেও তিনি যৌনকামনার বশবতী করে মানবজীবনের আদিম, অকৃত্রিম যৌনপ্রেষণাকে শিল্পিত করে তুলেছেন। তাই মানিকের প্রান্তিক মানুষেরা যৌনকামনা চরিতার্থ করার জন্যও সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। সীমাহীন অভাব সত্ত্বেও ব্যভিচারী হয়ে ওঠে। জৈবিক প্রেষণায় তাড়িত মানুষ নির্মাণ ও বিনির্মাণের চক্রে নিজের মনস্তত্ত্বকে প্রতিনিয়ত চূর্ণ করে চলে।
মানিক-উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষগুলোর সংকট তাদের জীবনসংগ্রামের পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকট জীবনসংগ্রামে আরো বেশি শক্তি সঞ্চার করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রান্তিক মানুষের জীবনবোধকে এমনভাবে পাল্টে দিয়েছে যে, তারা শোষণ-বঞ্চনা ও অন্যায়কে জীবনসংগ্রামের অনুষঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই মেনে নেওয়া মানে উত্তরণের নতুন গতিপথ নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হওয়া। এই নির্মাণের সঙ্গে শুধু জীবিকা নয়, জীবননির্মাণের বিষয়টিও জড়িত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘জননী’র কাহিনি আবর্তিত হয়েছে প্রায় প্রান্তিক একটি বাঙালি পরিবারের বধূ ও পরবর্তী সময়ে জননী হয়ে ওঠা শ্যামা নামের এক নারীর সুখদুঃখময় সংগ্রামী জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকা শ্যামা আর্থিক বিবেচনায় যেমন প্রান্তিক মানুষ তেমনি দৃঢ় মনোবলের নিরিখে একটি আত্মনির্মাণের প্রতীক। প্রতিনিয়ত নির্মাণের মধ্য দিয়েই শ্যামার জীবন এগিয়ে চলে।
মানিকের আর এক কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ প্রান্তিক মানুষের আত্মনির্মাণের এক অনবদ্য দলিল। এ উপন্যাসে মানিক প্রান্তিক মানুষকে সংকট থেকে সংগ্রাম ও সংগ্রাম থেকে আত্মনির্মাণের দিকে নিয়ে গেছেন। পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর গ্রামের প্রান্তিক জেলেছেন জীবন-জীবিকা ও শোষণ-বঞ্চনার চিত্র উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। উপন্যাসে দেখা গেছে প্রান্তিক জেলেরা স্বজাতির সচ্ছল জেলেদের দ্বারা শোষিত হয়। আবার চালানবাবুরা জমিদার ও জমিদারের লোকদের দ্বারা শোষণের শিকার হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণিশোষণের নিরিখে সামাজিক স্তরবিন্যাসের চিত্র দেখিয়েছেন। এই স্তরবিন্যাসের সর্বনিম্নে থাকে প্রান্তিক জেলেরা। এসব জেলেদের শোষিত-বঞ্চিত ও অবহেলিত জীবন। এরা মাছ ধরে। কিন্তু নৌকা ও জালের মালিক হতে পারে না। এরা শ্রম দেয় বেশি। কিন্তু ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। কুবের ও গণেশ এদেরই প্রতিনিধি। হোসেন মিয়া কেতুপুরের প্রান্তিক মানুষদেরকে ময়না দ্বীপে নিয়ে যেতে চায়। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই ময়না দ্বীপে যায়। কিন্তু ভাগ্য তাদের আরো বেশি প্রতারিত করে। মানিকের প্রান্তিক মানুষেরা জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয় বটে; কিন্তু প্রতিটি সংগ্রামে আত্মনির্মাণের গতিপথ আবিষ্কার করে চলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ‘চিন্তামনি’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রান্তিক কৃষকদের সংকট, সংগ্রাম ও আত্মনির্মাণের চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রান্তিক কৃষকদের দুরবস্থার কারণ এখানে নানাবিধ।
যুদ্ধের কারণে খাদ্যাভাব একটি প্রধান কারণ হলেও গ্রাম্য সুদখোর মহাজন ও দাদনদারদের অন্যায় ও নীতিহীন শোষণ এ দুরবস্থার অন্যতম কারণ। একদিকে ঋণের চাপে কাতর অন্যদিকে ম্যালেরিয়া ও কলেরার মতো মহামারি রোগে আক্রান্ত হয়ে ‘চিন্তামনি’ উপন্যাসের প্রান্তিক মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ দুরবস্থার কারণেও তাদের জীবনবোধ পাল্টে যায়। জীবন সম্পর্কে এক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। উপন্যাসে গৌর ও চিন্তামনির জীবনসংকট এমন এক বাস্তবতা যা অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। তার মানে প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবন সব সময়ে এমন এক সংকট ও সংগ্রামের ঘূর্ণাবর্তে ক্রিয়াশীল যা প্রান্তিক মানুষ সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। ফলে সংকট ও সংগ্রামের মধ্যেই প্রান্তিক মানুষ নিজেকে নির্মাণ করে নেয়। এই আত্মনির্মাণ এক ধরনের জীবনবোধ। প্রান্তিক মানুষের জীবনসংকট ও জীবনসংগ্রামের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ‘মাটি ঘেঁষা মানুষ’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রেবতী নামে এক চাষির মেয়ের জীবনবোধের স্বরূপ সন্ধান করেছেন। রেবতীর সঙ্গে সমাজের চাষাভূষা, কুলি-মজুর ও কারখানায় খেটে খাওয়া মানুষের আন্তঃসম্পর্ক একটি মনোজাগতিক সংকট থেকেই উৎসারিত হয়েছে।
প্রান্তিক মানুষের আত্মনির্মাণ এ লেখার উপজীব্য। তাই বলে মানিক শুধু প্রান্তিক মানুষের আত্মনির্মাণের চিত্র উপস্থাপন করেননি। মানিকের উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মাণ করে চলেছেন। এ আত্মনির্মাণের ক্ষেত্রে সংকট ও সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সংগ্রাম- এই দুটি বিষয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। একটি সংকট কেটে গেলে আর একটি নতুন সংকট এসে চরিত্রগুলোকে সক্রিয় করে তুলেছে। একটি সংগ্রাম শেষ হলে আবার নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে মানিকের চরিত্ররা।
এভাবে সংকট, সংগ্রাম ও আত্মনির্মাণের জীবনচক্রে মানিক তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর যাপিত জীবনকে বহমান রেখেছেন। চরিত্রগুলো প্রান্তিক সমাজের জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণিশোষণের দৃষ্টিকোণ থেকে মানিক তার চরিত্রগুলোকে নির্মাণ করেছেন। ফলে সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার ভেতর দিয়েই এগিয়ে চলেছে মানিক-উপন্যাসের প্রান্তিক মানুষ ও সমাজ।
সময়ের আলো/আরএস/