
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকিং সংকট মোকাবিলায় টাকা ছাপানোর বিপক্ষে শক্ত মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। অর্থনীতিবিদগণও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে টাকা না ছাপানোর পক্ষে মতামত দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিন মাস না পেরোতেই তারল্য সংকটে পড়া ছয়টি ব্যাংককে করুণ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে এবং গ্রাহককে আস্থায় ফেরাতে নতুন করে টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হন।
গভর্নরের মতে সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে বড় আকারে সাহায্য করতে না পারলে এ সংকট শিগগিরই কাটছে না। বেসরকারি ছয়টি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থার নাজুক পরিস্থিতি সম্পর্কে কম-বেশি সবাই অবগত। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত এমন খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য গভর্নর প্রকাশ করেছেন। তা ফিরিয়ে আনা নিয়েও সংশয় রয়েছে। মন্দা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ স্থবিরতা, সীমিত ঋণের সুযোগ, অতিরিক্ত সুদহার এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে সে নিয়ে এখনও দ্বিধাবিভক্ত মত রয়েছে। নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। চাহিদামতো টাকা না পেয়ে বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ। নতুন ছাপানো টাকা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে সন্দেহ নেই। অর্থনীতিবিদসহ অনেকের ধারণা বাংলাদেশের অর্থনীতি কি মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে?
অর্থ উপদেষ্টার আশ্বস্ত করেছেন কিছু ব্যাংক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও কোনো ব্যাংকই বন্ধ করা হবে না। চরম তারল্য সংকটে পড়া এই খুঁড়িয়ে চলা ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কতদিন থাকবে? বিভিন্ন ব্যাংকের দুর্দশার খবর জনমনে শুধু ব্যাংক নয় পুরো আর্থিক খাত নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। এখনও কিছু ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলতে পারছে না গ্রাহক। তা দেখে অনেকেই টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। চাহিদার ন্যূনতম পরিমাণ মেটাতেই ব্যর্থ হচ্ছে তা সবখানে দৃশ্যমান।
অন্যদিকে ব্যাংক কর্মীদের প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা বেতন-ভাতা নিতে সমস্যা হচ্ছে না এমন কথাও উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে কিছু সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে আর্থিক সহায়তা দিলেও নগদ প্রদানে সঙ্গে সঙ্গেই সে অর্থ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেসব ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ টাকা উত্তোলন করছে তার কোনো অংশই জমা হচ্ছে না। তা ছাড়া যারা ঋণের সুদ গুনছে তারাও কিন্তু টাকা তুলতে পারছে না। যারা মাসিক সুদের টাকা দিয়ে সংসার চালান তাদেরও পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। খুব অল্প পরিমাণ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার ছোট চেক ক্লিয়ারিং আওতায় পাস করছে।
সরকার বৃহত্তর স্বার্থেই এসব ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বৃহত্তর স্বার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে কিছু সমালোচনা খুব চাউর হচ্ছে। যা জনমনে শঙ্কা তৈরি করছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক বেড়েছে। এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয় ব্যাংকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা পতিত সরকারের কর্মী-সমর্থকরা নেতিবাচকভাবে প্রচার করছে।
ব্যাংকিং খাতের নজিরবিহীন দুর্নীতির ইতিহাস যারা মাত্র তিন মাসেই ভুলে যায়। সরকার ভুল করলে সরকারের সমালোচনা হবে এটি খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু দেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনা ও এস আলম যে এসব ব্যাংকের অসহায় আমানতকারীদের সঙ্গে ভয়াবহ অন্যায় করেছে, সেটিকে তাদের ধামাচাপা দেওয়ার এত চেষ্টা কেন? তারা কেন এসব নিয়ে কথা বলছে না?
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান শ্বেতপত্র উপস্থাপনকালে বলেন, সমস্যা যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও গভীর। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজার দরে তার পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। চিন্তা করা যায় কী ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে?
যারা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন তারা একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। এসব ব্যাংকে যেসব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরা জীবনে সবটুকু আমানত রেখেছে তাদের প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত কেমন কাটছে? আপনার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলে কী করতেন? এখানে কারা কোন দলের লোক টাকা রেখেছে বলতে পারেন? ন্যূনতম বিবেকবোধ থাকলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে মিথ্যা ষড়যন্ত্র থেকে দূরে থাকুন। দেশ ভালো থাকা না থাকা অনেকটাই এখন এই ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভর করছে। ব্যাংকিং খাতের অবশিষ্ট যা আছে তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে দিন।
প্রশ্ন থাকতে পারে টাকা না ছাপিয়ে ব্যাংকিং সংকট থেকে উত্তরণের কি কোনো উপায় ছিল না? কয়েক দিন চেষ্টা করার পর এখন অন্তত তাই মনে হচ্ছে। এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত টাকা না ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো। কেননা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংকিং খাতকে সংকট উত্তরণ বেশি জরুরি। না হলে ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ বিপর্যয় অর্থনীতি ও সরকারকে আরও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। এমতাবস্থায় অনেকের মতে বেসরকারি ছয় ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিতেই ব্যাংক ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নতুন ছাপানোর সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে যে অস্থিরতা চলছে তা নিরসনেই কাজ করছে সরকার। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি ব্যাংকের সব গ্রাহক টাকা তুলে ফেলতে চাইলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংকই সব টাকা গ্রাহককে একসঙ্গে দিতে পারবে না। কিন্তু সব গ্রাহক একসঙ্গে কেন টাকা তুলতে চাইছে তা গভর্নর ভালো করেই জানেন। সাধারণ গ্রাহক সব ব্যাংকে টাকা রাখে না, একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকেই রাখে। প্রয়োজনে টাকা তুলতে না পারলে অন্যদের যাদের সব টাকা ওই নির্দিষ্ট ব্যাংকে তাদের সব টাকা চাওয়া ছাড়া উপায় কী?
অন্যদিকে এসব দুর্বল ব্যাংক আবার আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করেছে। আমানত সংগ্রহে তুলনামূলকভাবে সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ৫-৬ বছরে দ্বিগুণের অফার চলমান। এক হিসাবে দৈনিক মুনাফা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেন? এসব ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদে আবারও বিপদে পড়তে বাধ্য। এসব ব্যাংক কোথা থেকে গ্রাহকের মুনাফাসহ এসব টাকা পরিশোধ করবে?
তা ছাড়া নতুন করে তেমন কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। এসব ব্যাংকে নিয়মিত সাধারণ গ্রাহক নতুন করে কোনো টাকা জমাও দিচ্ছেন না। ফলে দুর্বল ব্যাংক দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
আর উচ্চ সুদের হারে আমানত সংগ্রহে দীর্ঘমেয়াদে এসব ব্যাংক নতুন করে সংকটে পড়তে পারে। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা পেলে এসব ব্যাংকের বড় বড় আমানতকারীদের টাকা অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই দুর্বল ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদে সংকট থেকে উত্তরণে পথ এখনই বের করতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে লাইভ সাপোর্ট দিয়ে সরকার কতদিন বাঁচাতে পারবেন? দুর্বল ব্যাংকের দোহাই দিয়ে এসব ব্যাংককে বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া কতটুকু যুক্তিসংযত? সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো একীভূত করে সমাধান করার চেষ্টাও সফল হয়নি? অথবা আদৌ সম্ভব হবে কি?
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মুদ্রাস্ফীতির রাশ টানতে যেসব যুক্তি দিচ্ছেন তাতে সাময়িক কিছুটা কাজ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব এড়ানো যাবে না। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণেই সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। আপাতত এতে জনগণেরও সায় আছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের এই দুর্বল অবস্থার জন্য দায়ীদের ছাড় দিয়ে নয়। টাকা পাচারকারীসহ দায়ীরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে।
সাধারণ জনগণ নতুন টাকা ছাপানো কিংবা মুদ্রাস্ফীতি সংকোচন নীতি বোঝেন না, তারা তাদের টাকা ফেরত চায়। সচেতন নাগরিকরা চায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এখন একটাই প্রশ্ন নতুন টাকা দ্রব্যমূল্য কি কমাতে পারবে? সর্বোপরি নতুন টাকা ছাপানোই ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটবে কি।
গভর্নরকে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে তারল্য সহায়তা পাওয়ার পর এসব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রাহক তুলে নিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর করবে খুব স্বাভাবিক কারণেই। তাই এসব ব্যাংকের সংকট শিগগিরই কাটছে না বলা যায়। ভবিষ্যতে এসব ব্যাংকের ভাগ্যে কী পরিণতি আছে তা আপাতত আন্দাজ করা ভুল হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে এ সরকারের বড় সাফল্য জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারা এবং প্রতিনিয়ত গ্রাহকের অনুকূলে সরকারকে ভূমিকা রাখা। হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও জনগণ জানে যে ব্যাংকেই তার টাকা থাকুক তার টাকা নিরাপদে আছে।
সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সহায়তা পাওয়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকেই সংকট কাটিয়ে জনগণের আস্থায় আনতে হবে। তাই আপাতত দেউলিয়াপনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এসব ব্যাংক নিরাপদ থাকলেও ভবিষ্যতে তাদের টিকে থাকার সংকট থেকেই যায়। তবে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই।
এমফিল গবেষক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
সময়ের আলো/আরএস/