মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম কলব বা অন্তর। অন্তরের ভূমিকা মানবজীবনে প্রতিফলিত হয় সবচেয়ে বেশি। অন্তর যার ভালো, সুস্থ ও সুন্দর; বাহ্যিক আচার-আচরণ জীবনযাপন তার সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। আর অন্তর যার অসুস্থ, অসুন্দর ও অপবিত্র স্বাভাবিক জীবনেও সে অশৃঙ্খল এবং বেপরোয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
হজরত নুমান ইবনে বাশির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো, মানব শরীরে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে, যা ঠিক হয়ে গেলে সম্পূর্ণ শরীর ঠিক হয়ে যায়। আর তা নষ্ট হয়ে গেলে গোটা শরীরই বিনষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরা হলো অন্তর’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২)। অন্তরকে রোগমুক্ত করতে হলে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত কিছু পথ্য আমাদের মেনে চলতে হবে।
কুরআন তেলাওয়াত : কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অন্তর পরিবর্তন হয়। কঠিন অন্তর বিগলিত হয় মোমের মতো। অসৎ কাজ পরিহার করে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা জাগে। এজন্য বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভব হলে অনুবাদসহ পড়া উচিত। তা হলে অন্তরজুড়ে এর প্রভাব বেশি পড়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিন তো তারাই, আল্লাহর নাম নেওয়া হলে যাদের অন্তর হয় ভীত। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কুরআন, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশবাণী (কুরআন) ও তোমাদের অন্তরে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫৭)
দোয়া করা : দোয়া একটি মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইসলামি শরিয়ত দোয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে খুব। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়াকে সব ইবাদতের মূল বলে আখ্যায়িত করেছেন (তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৭১)। এজন্য অন্তর পবিত্র রাখতে আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। এর মাধ্যমে অন্তর নরম হয়। সৎকাজের আগ্রহ, উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। অন্তরকে দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে মহানবী (সা.) এই দোয়া করতেন, ‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তরকে দ্বীনের ওপর অটল রাখুন’ (সুনানে আহমদ, হাদিস : ১৭৬৩০)। অন্য হাদিসে নিম্নোক্ত দোয়ার কথাও বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী! আমাদের অন্তরসমূহ আপনার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৭৫০)
মৃত্যুর কথা স্মরণ : অন্তরের রোগ দূর করার অন্যতম একটি উপায় হলো অধিক পরিমাণে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। যে যত বেশি মৃত্যু, কবর, হাশর, বিচার দিবস তথা পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ করবে, তার পাপের আকাংখা ততবেশি কমতে থাকবে। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন জানাজার নামাজে এসে দেখলেন, কিছু লোক হাসাহাসি করছে। তিনি বললেন, ওহে! তোমরা যদি জীবনের স্বাদ ছিন্নকারী মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করতে, তা হলে আমি তোমাদের যে অবস্থায় দেখছি তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে। তোমরা জীবনের স্বাদ ছিন্নকারী মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৬০)
কবর জিয়ারত : কবরস্থানে গেলে মানুষের পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ হয়। হৃদয়জুড়ে এই ভাবনা জাগ্রত হয় যে, আমার মতো কবরের বাসিন্দাদেরও তো একদিন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ ছিল। আজ তারা মাটির নিচে সমাহিত। আমাকেও এক দিন তাদের মতো বিদায় নিতে হবে ধরাপৃষ্ঠ হতে। এভাবে কবর জিয়ারত মানব মনের পাপ-আকাক্সক্ষা কমিয়ে দেয়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। শোনো! তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা তা অন্তরকে নরম করে, চোখকে অশ্রুসিক্ত করে এবং পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৩৪৮৭)
জিকির করা :অন্তরের কঠোরতা বিদূরিত করার অন্যতম মাধ্যম হলো জিকির। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর জিকির দ্বারা অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)। হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের জিকির করে আর যে জিকির করে না, তাদের উপমা হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)। এ ছাড়াও বেশি বেশি ইস্তেগফার, আলেম বুজুর্গ ও সৎলোকের সংস্রব, আল্লাহ তায়ালার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা, খারাপ ও গর্হিত কাজ থেকে তওবা, তাকওয়া, দান-সদকা, আত্মসংযম, দৃষ্টির হেফাজত প্রভৃতির মাধ্যমে অন্তরের রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ
রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
সময়ের আলো/আরএস/