বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি হয়। বর্ষা শেষ হয়েছে। শীত এসে গেছে। তবু ডেঙ্গু উদ্বেগজনক পর্যায়েই রয়ে গেছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন মানুষ। ডেঙ্গুতে নিয়মিত মৃত্যুও হচ্ছে। শুক্রবার ডেঙ্গুতে দেশে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আরও ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭ জনের মৃত্যু হয়। চলতি মাসের ২৯ দিনে ডেঙ্গুতে ১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ হাজার ৯৭৭ জন। সবমিলিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৪৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯০ হাজার ৭৯৪ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীরবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩০ হাজার ৮৭৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১৩৪ জনের। সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৮ হাজার ৯৭ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৮০ জনের। আগস্টে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের। বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বর্ষাকালে বেড়ে শীতকালে কমলেও চলতি বছর শীত শুরু হলেও আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বছরের প্রথমদিকে ডেঙ্গু ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লেও জুন-
জুলাই মাসে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দেশে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে।
আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে কিছু সংখ্যক বাড়তে শুরু করলেও সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিদিন ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। একই সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি।
তার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না থাকা ও রোগী শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসাই মৃত্যুর প্রধান কারণ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর নতুন ভয় গ্রামে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ডেঙ্গু ছিল মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এরপর প্রতি বছর কমবেশি ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে। ২০১৯ সালে বড় বড় শহরের পাশাপাশি গ্রামেও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। উপকূলের জেলাগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন ঝুঁকি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
এ বছর ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, বহু গ্রামের মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সাধারণত বড় বড় শহরে চোখে পড়ে। গ্রামে সেই কার্যক্রম নেই। গ্রামের মানুষের করণীয় সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তাও নেই। গ্রামে তাই ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. আবদুল আলীম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এডিস মশা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। নগরকেন্দ্রিক এডিস মশার প্রজননকাল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। মূলত বর্ষায় মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি থাকত। কিন্তু এডিশ মশা এখন সারা দেশে, সারা বছর প্রার্দুভাব দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিধনের জন্য আলাদা আলাদা কর্মসূচি রাখতে হবে। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ ও শিক্ষাসহ সব বিভাগের মধ্যে সমন্বিত একটি উদ্যোগ দরকার।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতার জন্য যে কাজ সেটা কিন্তু কোনো সরকারই করছে না। গতানুগতিক কায়দায় মাঝেমধ্যে রাসায়নিক ছিটাচ্ছে। এখানে সমন্বিতভাবে কীটত্ত্ববিদদের রোগতত্ত্ববিদের সঙ্গে সমন্বিত করে কাজ করতে হবে।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, মশার চরিত্র পাল্টেছে। বর্ষায় শহরকেন্দ্রিক এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুর ধরন পাল্টেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সময়ের আলো/আরএস/