বৃহত্তর অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনগুলোকে নির্দেশ করে। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন-বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার চলমান বৃদ্ধি। পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর এর ব্যাপক প্রভাবের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন এখন পরিবেশবাদীসহ সবার প্রধান আলোচ্য বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এই দুই ধরনের কারণ মূলত দায়ী।
প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে ১. সূর্যের কার্যকলাপের পরিবর্তন-সূর্যের বিকিরণ এবং সূর্যের বৃত্তাকার গতিপথের পরিবর্তন জলবায়ুর ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে; ২. ভূ-প্রকৃতি পরিবর্তন-আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পর্বত শ্রেণির সৃষ্টি এবং ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন জলবায়ুর ওপর বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক প্রভাব ফেলছে; ৩. প্রাকৃতিক বিপর্যয়-যেমন ভূমিকম্প, সুনামি এবং ঝড় বিভিন্ন স্থানে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটায় যা জলবায়ুতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। আবার মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে ১. জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো-শিল্প কারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যা গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টি করে; ২. বনভূমি ধ্বংস-যার ফলে কার্বন শোষণের হার কমে যায় এবং অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমা হয়; ৩. শিল্প ও কৃষিজ কার্যক্রম-এগুলো থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন রাসায়নিক, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে সাহায্য করছে। প্রকৃতপক্ষে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ¦ালানি পোড়ানো, জীবাশ্ম জ্বালানির অপব্যবহার, বন উজাড়, এ ছাড়াও কিছু কৃষি ও শিল্প থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির অধীনে, দেশগুলো সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে প্রাক শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০ সালের) গড় তাপমাত্রার তুলনায় ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে বজায় রাখতে সম্মত হয়েছিল। বরং বাস্তবতা হলো চুক্তির অধীনে করা অঙ্গীকারের কোনো ধারাই সত্যিকার অর্থে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলো মেনে চলছে না বরং তারা অযৌক্তিক মতবাদ দাঁড় করাচ্ছে। উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ করার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন অর্ধেক করতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী নির্গমন ও শোষণের পরিমাণ ‘নিটশূন্য’ অর্জন করতে হবে। যা বিশ্বের অধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলোর আচরণে সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ যদিও ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একাধিক পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করছে যেমন-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান; বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড; অভিযোজন ও মিটিগেশন কর্মসূচি; আর্ন্তজাতিক অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা; কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজন। তবুও এখন পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে এই উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের জনগণের জীবনমান রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় খুব সামান্যই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তাই ১৩ নভেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নতুন বিশ্ব গড়তে ’তিন শূন্য’ তত্ত্ব তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো মানবসৃষ্ট-এ সমস্যার সমাধানে ও সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য জরুরি শূন্য কার্বন, শূন্য দারিদ্র্য ও শূন্য বেকারত্ব তত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ। এই তত্ত্বে প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ ও সমাজের টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই তত্ত্ব আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মঠ জনগোষ্ঠী তৈরি এবং পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় এবং কার্যকরী একটি মডেল রূপে মনে করা হচ্ছে।
দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে বন নিধনসহ অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের প্রবণতা হ্রাস পাবে। এ ছাড়াও তেমনি দেশীয় এনজিও (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেমন-গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা এর মতো প্রতিষ্ঠান) সামাজিক উদ্যোগ যেমন-টেকসই কৃষি ও শিল্প এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব হলে তা পরিবেশের ওপর চাপ কমাবে। এ ছাড়াও নবায়নযোগ্য শক্তি বা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি খাতে সবুজ চাকরির সুযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব।
‘শূন্য বেকারত্ব’ বলতে এমন একটি সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে কর্মক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তি তার দক্ষতা অনুযায়ী একটি অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি বাস্তবায়নের জন্য তিনি সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে উৎসাহিত করেন। সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য ননডিভিডেন্ট ব্যবসা হিসেবে মনে করেন যার বিশাল অংশ পরিবেশ ও মানব জাতির সুরক্ষায় মনোযোগ দেবে।
প্রধান উপদেষ্টা নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে তিন শূন্য তত্ত্বের সঙ্গে এবার তরুণদের ও যুক্ত করেছেন। তরুণরা ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বের জীবন ধারাভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠলে পৃথিবী হয়ে উঠবে বাসযোগ্য কাক্সিক্ষত স্বপ্নের জায়গা; সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণদের পাশাপাশি বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকার গৃহীত কার্যক্রমেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টেকসই উন্নয়নে ‘তিন শূন্য’ তত্ত্ব যুক্ত করার চিন্তা করছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এ তত্ত্বের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হবে। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মূলে রয়েছে সবার জন্য কল্যাণকর পৃথিবী এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামানো সম্ভব হলে দুশ্চিন্তামুক্ত ও বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে, সঙ্গে সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে তিন শূন্য তত্ত্ব অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
তিন শূন্য নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের তরুণ-তরুণী চাকরিপ্রার্থী না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে এবং অধিক সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ পাবে-যা সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে। ফলে সামাজিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি ভোগবাদী জীবনধারা থেকে বের হয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে সৃজনশীল হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে।
সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় তিন শূন্য তত্ত্বের সফলতা নির্ভর করছে সদস্য দেশগুলোর অঙ্গীঁকার, সহযোগিতা এবং অতি দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর। এ ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশ ও বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন একতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সবার শুভবুদ্ধির উদয় হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে পৃথিবী হবে স্বপ্নের বাসস্থান-এটাই সবার প্রত্যাশা।