প্রকাশ: বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪, ৮:২৫ এএম (ভিজিট : ৫৮০)
১৯৫৮ সালের ৫ অক্টোবর পুরান ঢাকায় জন্ম হাজী মোহাম্মদ সেলিমের। পড়ালেখা মাত্র নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে পাস করেছেন কি না, তা জানা যায়নি।
স্বাধীনতার আগে হাজী সেলিমের বাবা চান মিয়া ছিলেন সোয়ারীঘাটের পান বিক্রেতা। পিতার সঙ্গে পান বিক্রির মধ্য দিয়ে ব্যবসা জগতে পা রাখেন তিনি। স্বাধীনতার পরও পান বিক্রি করেই সংসার চলত এই পরিবারের। একপর্যায়ে কোমলপানীয় সেভেন আপের এজেন্সি খুলেন। ওই এজেন্সির আড়ালে নকল কোমলপানীয় বিক্রির অভিযোগে মোহাম্মদ সেলিম, তার বাবা চান মিয়া ও বড় ভাই কায়েস মিয়াকে আটক করে পুলিশ।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে মদিনা ট্রেডিং করপোরেশন নামে সিমেন্টের ব্যবসায় নামেন মোহাম্মদ সেলিম। শুরুর দিকে বাদামতলী থেকে জমাটবাঁধা সিমেন্ট এনে তা ক্রাশ করে বিক্রি করতেন তারা। একপর্যায়ে নিজেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে সিমেন্ট কারখানা খুলেন। সিমেন্টের সঙ্গে বালি ও মাটি মিশিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি-আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের পান ব্যবসায়ী থেকে হাজী মোহাম্মদ সেলিম হয়ে উঠেন মদিনা গ্রুপের মালিক। একপর্যায়ে ফলের ব্যবসা শুরুর মধ্য দিয়ে বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন তিনি। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজী সেলিমের নাম। অন্যায় অনিয়মের পথ ধরেই তার উত্থান। আর নিজের সেই উত্থান আরও এগিয়ে নিতে রাজনীতিকে ‘মই’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বেছে নিয়েছেন ‘ক্ষমতার রাজনীতি’।
নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন পেয়ে লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর নির্বাচনী এলাকার এমপি হন হাজী সেলিম। এরপর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে তার ব্যবসা ও সম্পত্তির পরিমাণ। পুরান ঢাকার স্থানীয়রাও জানান তার অপকর্মের কথা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই সময় হাজী সেলিম নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন পাড়া-মহল্লাগুলোয় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেন। ওই সময় অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আসত। এরমধ্যে জমি বা বাড়িসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতেও তার সহযোগিতা চাইতে আসতেন স্থানীয়রা। কিন্তু এসব বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে হাজী সেলিম নামমাত্র মূল্যে ওই জমির কাগজপত্র কিনে নিতেন। জোরপূর্বক উচ্ছেদের জন্য বিচার শেষে তিনি ঘরে বা দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। এজন্য এলাকায় ‘তালা হাজী’ নামেও খেতাব পেয়েছিলেন তিনি।
স্থানীয়রা আরও জানান, যেখানেই চোখ পড়েছে হাজী সেলিমের, সেটাই দখল করে নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে গত বছরও ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে পরিচিত চকবাজারের শতবর্ষেরও বেশি পুরনো জাহাজবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম। ক্ষমতাধর হওয়ার কারণেই হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় অভিযোগ করতে চায়নি। এভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছেন তিনি। জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অসংখ্য বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনেছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনীঘাটে ওয়াসার পানির পাম্পের জমি দখল করে সেখানে পেট্রলপাম্প তৈরি করেন হাজী সেলিম। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন কামালবাগের জমির কাগজপত্র জালিয়াতির হোতা হিসেবে পরিচিত হাফেজ কামাল। এছাড়া সোয়ারীঘাটে নদীতীর দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ। এরপর নবাববাড়ী এলাকায় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবাস দখল করে সেখানে গুলশান আরা প্লাজা নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। আরমানিটোলা এলাকায় এক বৃদ্ধার সম্পত্তি দখল করে নির্মাণ করেন এমটিসি টাওয়ার। নলগোলায় ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি দখল করে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন।
শুধু তা-ই নয়, হাজী সেলিম চকবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট ও জেলখানার পাশে ৫০-৬০ বছরের পুরনো ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে সেখানে মদিনা আশিক টাওয়ার ও হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করেন। মার্কেট নির্মাণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নতুন দোকান দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই কোনো দোকান দেননি তিনি। এ কারণে দুই ব্যবসায়ী আত্মহত্যাও করেছেন বলে জানা গিয়েছে। এভাবেই হাজী সেলিম রাজধানীর পুরান ঢাকার বাদামতলী, নবাববাড়ী, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর রোড, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা এলাকায় জমিজমার মালিক হন। এছাড়া একসময়ে খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের সঙ্গেও ব্যবসা করেছেন হাজী সেলিম। বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অন্তত ১২০টি মামলা দায়ের করা হয় হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। খুন, খুনের চেষ্টা, নির্যাতন, চুরি এবং দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের কারণে এসব মামলা দায়ের করা হয়।
কেরানীগঞ্জের বসিলার ঝাউচর এলাকায় দখল করে মদিনা মেরিটাইম লিমিটেড হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে। চারটি জাহাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে লাগানো হয়েছে আকাশমনি, রেইনট্রিসহ নানা জাতের গাছ। ছবি তুলতে গেলে এখানকার কর্মচারীরা ছবি তুলতে নিষেধ করেন। একপর্যায়ে হাজী সেলিমের পিএস বেলাল ফোন করে অনুরোধ জানান ছবি না তুলতে। বলেন, নদীর এই জমি হাজি সেলিম ভরাট করেননি। তিনি বিআইডাব্লিউ থেকে লিজ নিয়েছেন। অথচ বিআইডাব্লিউটিএর কাছে এমন কোনো তথ্যই নেই।
এই জায়গার আরেকপাশে রাখা আছে পাথর। এসব পাথর পদ্মাসেতুর রেল লাইনে সরবরাহ করে মদিনা মেরিটাইম। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হাজি সেলিমের বিশ্বস্ত মদিনা মেরিটাইম লিমিটেডের সিনিয়র জিএম কামরুল হাসান পদ্মা সেতুর রেলে নিম্নমানের এবং পরিমাণে কম পাথর দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এখন নিজেকে সেইফ করতে আমেরিকা যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। বাকশক্তি না থাকায় এই ম্যানেজারই তার হয়ে সকল কাজের ডিল করেন। ফলে প্রত্যেক কাজেই একদিকে হাজি সেলিম দুর্নীতি করছেন, অন্যদিকে সেলিমকে অন্ধকারে রেখে সিনিয়র জিএমও দুর্নীতির সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।
এদিকে নিজের অধিপত্য ধরে রাখতে শুধু দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যই নয়, দলীয় নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগও আছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাজধানীর লালবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্যানারে নিজের নাম আর ছবি না থাকায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরকে পেটান ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। এ সময় অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে মাইক ও বিভিন্ন সরঞ্জাম ফেলে দেন তার কর্মীরা।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর বুড়িগঙ্গা নদী তীরে হাজী সেলিমের মদিনা ট্যাঙ্কের শোরুম ও গোডাউনসহ ১৭১টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। এ সময় আলোচিত এ সংসদ সদস্যের পেট্রোল পাম্পের কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়। এ ছাড়া সোয়ারীঘাট থেকে কামালবাগ পর্যন্ত পাঁচতলা বিশিষ্ট পাঁচটি টিনের ঘর, চারতলা বিশিষ্ট আটটি টিনের ঘর, ১০টি দোতলা টিনের ঘর, পাঁচটি পাকা দোতলা ভবন, ১০টি পাকা একতলা ভবন, ৩৫টি আধা পাকা ঘর, ৭০টি টং ঘর, একটি কার ওয়াশ রুম, দুটি স্টিলের গোডাউন ও ২৫টি দোকান মোট ১৭১টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
সময়ের আলো/এএ/