রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন না মঞ্জুরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালত ভবন এবং আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চিন্ময় সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ ও আইনজীবীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫) নামে এক আইনজবী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক সময়ের আলোকে বলেন, আলিফকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান।
এদিকে আইনজীবী আলিফ হত্যা ও ভাঙচুরের পর উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ লাঠিচার্জের পাশাপাশি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। বিকাল ৪টার পর লালদীঘিসহ আশপাশের এলাকা শান্ত হয়ে এলেও পরিস্থিতি ছিল থমথমে। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতে লালদীঘি ও আন্দরকিল্লাসহ আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে বুধবার চট্টগ্রামের আদালত বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের সময় চার সাংবাদিকের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে ইসকন সমর্থকরা। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)।
আদালত সূত্র জানায়, রাষ্ট্রদোহ মামলায় গ্রেফতার চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে মঙ্গলবার সকালে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন। আদেশের পরপরই এজলাসের বাইরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন চিন্ময়ের ভক্ত-অনুসারীরা। তাদের বাধার কারণে তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যান আদালত চত্বর ত্যাগ করতে পারেনি। প্রিজনভ্যানের আগে-পিছে সনাতন ধর্মালম্বীরা জড়ো হয়ে মিছিল করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। কেউ কেউ প্রিজনভ্যানের সামনে সড়কে শুয়ে পড়েন। সেখান থেকে ইসকন সমর্থকদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে বেলা ৩টার কিছু সময় পর চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে নিয়ে কারাগারে পৌঁছায় পুলিশ।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারগারের সিনিয়র জেল সুপার মঞ্জুর হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, তাকে (চিন্ময় ব্রহ্মচারী) প্রিজনভ্যানসহ দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তাকে কারাগারে নিয়ে এসেছে পুলিশ। তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যান কারাগারে পৌঁছে গেছে।
অন্যদিকে ইসকন সমর্থক বিক্ষোভকারীদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করে জনতা। তারা অভিযোগ করে, ইসকন সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। বিকাল ৪টার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও থেমে থেমে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। পুরো এলাকায় পুলিশ-বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নামঞ্জুরের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের সামনে শত শত নারী-পুরুষ তাকে বহন করা প্রিজনভ্যান আটকে দেন। তারা স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেন। চিন্ময় কৃষ্ণের মুক্তি চেয়ে এক দফা, এক দাবি জানান তারা। সেখানে মোতায়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য প্রথমে নির্বিকার থাকলেও পরে অ্যাকশন শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় ধরে চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ‘জয় শ্রীরাম’, ‘দালালের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘জেলের তালা ভাঙব, চিন্ময় প্রভুকে আনব’, ‘কুরুক্ষেত্রের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, এসব স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকেই চিন্ময় কৃষ্ণ তার ভক্ত-অনুসারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। হ্যান্ডমাইকে তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নই। রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এমন কিছু করব না।’ তবে তিনি শান্ত থাকার জন্য বক্তব্য দিলেও ইসকন সমর্থকরা সংঘর্ষ অব্যাহত রাখে। পুলিশ লাঠিচার্জের পাশাপাশি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে বরিশাল, নাটোর, কোটালীপাড়া ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করেছে তার সমর্থকরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে চিন্ময় সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্যেই আইনজীবী আলিফকে কোপায় বিক্ষোভকারীরা। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, মঙ্গলবার বিকালে সাইফুল ইসলাম নামে একজন আইনজীবীকে আনা হয় চমেক হাসপাতালে। তাকে নিয়ে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়। তিনি আদালত এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন।
তার শরীরে জবাই বা অন্য কোনো চিহ্ন আছে কি না, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, জবেহ করে মৃত্যুর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে তার শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আছে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ অ্যাডভোকেট এনামুল বলেন, চিন্ময় দাশ ব্রহ্মচারীকে নিয়ে সৃষ্ট সংঘর্ষের সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। পরে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধন পান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, চিন্ময়ের জামিনকে কেন্দ্র করে ইসকন সমর্থকরা বেপরোয়া তা-ব চালায়। ধারালো অস্ত্র নিয়ে কোপাতে থাকে লোকজনকে। তাদের হামলায় আদালত ভবনের প্রবেশ মুখে লুটিয়ে পড়েন সাইফুল। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর মুক্তির আন্দোলনে সহকর্মী নিহতের প্রতিবাদে সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি। আজ সব আদালতে এ কর্মসূচির পালনের ঘোষণা দেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ঘোষণা দেন তিনি।
আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বলেন, তারা বেপরোয়া হামলা করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে, মসজিদের গ্লাস ভাঙচুর করেছে। এ সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে আমাদের একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। এটির জন্য আমরা সমিতির পক্ষ থেকে জরুরি মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মহানগর দায়রা জজ, জেলা দায়রা জজ, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সব আদালতের কার্যক্রম আমরা সাসপেন্ড ঘোষণা করছি।
তিনি বলেন, সংঘর্ষের উসকানিতে আওয়ামী লীগ আইনজীবীরা জড়িত। অ্যাডভোকেট রিগ্যান এবং শুভাশিষ শর্মা আওয়ামী লীগের লোক। আওয়ামী লীগের লোকরাই ইসকনের নাম ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে। অ্যাডভোকেটদের মধ্যে আওয়ামী লীগের লোকরা ছিল কোর্ট বিল্ডিংয়ে। আমরা হিন্দু-মুসলিম বুঝি না। দলীয় অ্যাডভোকেটরা তা-ব ঠেকানোর চেষ্টা করলে ঘটনা এতদূর গড়াত না।
এদিকে ইসকন সমর্থকদের হামলায় আইনজীবী মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকাল থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। ফেসবুক পোস্টে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, জয়শ্রীরাম বলে ঘণ্টাখানেক তাকে পেটান ইসকন সমর্থকরা। এক পর্যায়ে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে শক্ত লাঠি দিয়ে দীর্ঘ সময় পেটানো হয়। এ সময় নিস্তেজ হয়ে পড়েন সাইফুল। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন সর্বস্তরের জনতা।
এদিকে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নিজ দলের কর্মী বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মঙ্গলবার ভোরে তাকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে সিএমপির কাছে হস্তান্তর করা হয়। বেলা ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে নেওয়া হয়। দুপুর ১২টায় হাজির করা হয় আদালতে। এরপর জামিন না মঞ্জুর হওয়ার খবর প্রকাশের পর শুরু হয় বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। তবে বিকাল ৪টার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। থেমে থেমে বিক্ষোভও অব্যাহত রয়েছে।
তদন্তের নির্দেশ : এদিকে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ নির্দেশনা দেন। প্রধান উপদেষ্টা জনগণকে শান্ত থাকার এবং অপ্রীতিকর কার্যকলাপে অংশ নেওয়া থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বন্দর নগরীসহ সব ঝুঁকিপূর্ণ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে ও সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সময়ের আলো/জেডআই