একজন মানুষ আরেক মানুষের স্পর্শে প্রভাবিত হয়। সুগন্ধির দোকানে গেলে শরীরে সুগন্ধি যুক্ত হয়, কামারের দোকানে গেলে লাগে পোড়া গন্ধ। তেমনি সৎ মানুষের সান্নিধ্যে গেলে জীবন সুন্দর হয়, অসৎ মানুষের স্পর্শে গেলে হয় অসুন্দর।
একইভাবে নেককারদের সান্নিধ্য কলব ও হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চার করে এবং হিম্মত ও প্রেরণা জাগ্রত করে। কারণ নেককার ব্যক্তিদের ইবাদত মগ্নতা এবং পুণ্যের কাজে উদ্যম ও প্রতিযোগিতা যখন অন্য মানুষ প্রত্যক্ষ করে তখন তাদের মধ্যেও পুণ্যের পথে চলার সাহস ও প্রেরণা জাগে। তেমনি তাদের আল্লাহমুখিতা ও দুনিয়াবিমুখতা যখন মানুষ প্রত্যক্ষ করে তখন তাদের মনেও এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের আগ্রহ জাগে। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন তিনি যেন এ ধরনের লোকদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধৈর্যের সঙ্গে নিজেকে সেসব লোকের সংসর্গে রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’ (সুরা কাহাফ : ২৮)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো’ (সুরা তওবা : ১১৯)। এই আয়াতে প্রথমে ঈমানদারদের তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের জন্য নেককারদের সাহচর্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ঈমান বা বিশ্বাসের কতগুলো স্তর আছে। কেবল মুখে কালেমা বললেই পূর্ণ ঈমান অর্জিত হয় না। অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং কাজকর্মে তার প্রতিফলন ঘটানোকে পূর্ণ ঈমান বলা হয়। নেককার বা সালেহিন বোঝাতে এ আয়াতে ‘সাদেকিন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ সত্যবাদী ও সত্যপন্থি। এতে জানা যায়, কুরআনের পরিভাষায় নেককার ওই ব্যক্তি, যার ভেতর ও বাইরে, নিয়ত ও ইচ্ছা এবং কথা ও কাজ সমান সত্য হয়। মানুষের কথার সত্যতা যেমন প্রয়োজন, কর্মের সততাও তেমনই প্রয়োজন।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, সত্যবাদী ও সৎকর্মশীলদের সংস্পর্শ মানুষকে ভালো হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে গুনাহ থেকে সহজেই বেঁচে থাকা যায়। কেননা মানুষ স্বভাবগতভাবেই পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত হয়। ফলে গুনাহের পরিবেশ বর্জন করে নেক ও সৎ লোকদের পরিবেশে নিজেকে নিয়ে এলে পাপাচার ছেড়ে দেওয়া সহজ হয়। পাপের পরিবেশ ছেড়ে পুণ্যের পরিবেশে আসা এবং বদকারদের ছেড়ে নেককারদের সাহচর্যে আসার এ প্রক্রিয়াকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়। আত্মশুদ্ধি হলো আত্মাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করা। নাপাকির কারণে যেভাবে দেহ অপবিত্র হয়, একইভাবে গুনাহের কারণে অন্তর অপবিত্র হয়। বাহ্যিক বিষয়ে ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, মদ্যপান, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি-দুর্নীতি, খুন-খারাবি ইত্যাদি পাপকাজ। একইভাবে আত্মিকভাবেও মানুষের অনেক পাপ-পঙ্কিলতা রয়েছে। অহংকার, আত্মগৌরব, লোক দেখানো কাজ করা, হিংসা, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ, অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা ইত্যাদি অন্তরের পাপ। অন্যদিকে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি বাহ্যিক আমল। আর ইখলাস, তাকওয়া, সবুর, শোকর ইত্যাদি হলো আত্মিক বা রুহানি আমল।
মানুষের বাহ্যিক যেকোনো কাজের মূল পরিকল্পনাকারী হলো আত্মা। মনোজগতের তুলনায় মানুষের বাহ্যিক আমলের পরিধি অত্যন্ত সংকুচিত। মানুষ এক মিনিটে বাহ্যিকভাবে যে কাজ করতে পারে, তার চেয়ে বেশি কল্পনা করতে পারে। তাই দৈহিক সততার পাশাপাশি আত্মিক বিশুদ্ধতা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি মনোজগতের বিশুদ্ধতা অর্জন করতে পারে, সেই পরিপূর্ণ সফল। সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তাশীল ব্যক্তিরা দুনিয়ায় সব ভালো কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন। এই নিয়ন্ত্রণকেই বলা হয় আত্মশুদ্ধি। এমন লোকদের জন্য আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘নিশ্চয়ই সে সফলকাম, যে তার আত্মাকে পরিচ্ছন্ন (পরিশোধিত) করেছে’ (সুরা শামস : ৯)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘সেদিন (কেয়ামতের দিন) ওই ব্যক্তি ছাড়া কারও অর্থসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো কাজে আসবে না, যে সুস্থ বা পরিচ্ছন্ন অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সুরা শুয়ারা : ৮৮-৮৯)
মানবজীবনে সঙ্গ লাভ কিংবা সংসর্গের প্রভাব কার্যকরভাবে বিদ্যমান। এ জন্য বলা হয়, নেক কাজের চেয়ে নেক সহবত উত্তম। আর বদ কাজের চেয়ে বদ সহবত নিকৃষ্ট। তাই তো প্রবাদে আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ সৎ সঙ্গের মাধ্যমে স্বর্গ তথা জান্নাত লাভ হয়। আর অসৎ সঙ্গের প্রভাবে অনেকের জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। একজন নষ্ট মানুষের কারণে শুধু একটি পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভালো-মন্দের উপমা দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সৎ লোকের সংশ্রব ও অসৎ লোকের সংশ্রব যথাক্রমে কস্তুরি বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরে ফুক দেওয়ার মতো। কস্তুরি বিক্রেতা হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু দান করবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিছু কস্তুরি ক্রয় করবে। আর অন্তত কিছু না হলেও তার সুঘ্রাণ তোমার অন্তর ও মস্তিষ্ককে সঞ্জীবিত করবে। পক্ষান্তরে হাপরে ফুকদানকারী তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে। আর কিছু না হলেও তার দুর্গন্ধ তুমি পাবে’ (বুখারি : ৫৫৩৪)। এসব হাদিস শরিফ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে একথা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, ভালো বা নেককার লোকদের সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে থাকলে ঈমান-আমল সব ঠিক থাকবে, পক্ষান্তরে বদ সহবত দ্বারা ঈমান-আমল ধ্বংস হয়ে যায়।
সময়ের আলো/আরএস/