ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বন্দর ঘুরে আমদানি রফতানিতে ব্যয় দ্বিগুণের বেশি
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ১:১৯ এএম  (ভিজিট : ৩০৮)
এশিয়ার কাছাকাছি সমুদ্রবন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে তৃতীয় দেশ ঘুরে পণ্য আমদানি হচ্ছে বাংলাদেশে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি হওয়ায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। স্িে সঙ্গে বাড়ছে পরিবহন ব্যয়ও। দেশে আমদানির পাশাপাশি ৯৫ ভাগ পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে। একমাত্র ব্যতিক্রম চীন থেকে বাংলাদেশে গড়ে মাসে ৮ থেকে ১০টি জাহাজ আসে সরাসরি। 

অন্যদিকে গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো কনটেইনার নিয়ে পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বন্দর থেকে সরাসরি পণ্য আমদানির বিষয়ে জোরালো আলোচনা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মতে, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর এড়িয়ে পাকিস্তানি জাহাজ বন্দরে ভেড়ায় আমদানি পণ্যের সরবরাহ দ্রুত হয়েছে। 

আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানান, সরাসরি যেকোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি লাভজনক। কনটেইনার পরিবহন ভাড়া পড়ে অর্ধেক। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে আমদানি কিংবা রফতানি হলে প্রতি কনটেইনারে ভাড়া পড়ে বেশি। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর মাধ্যমে আমদানি-রফতানি হলে নতুন করে পণ্য ওঠানামা করতে হয়। বাংলাদেশমুখী মাদার ভ্যাসেল থেকে নামানো কনটেইনার ওঠানামা চার্জ দিতে হয় পৃথকভাবে। বেশিরভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জট লেগেই আছে। 

শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর, সিঙ্গাপুর বন্দর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চলে। ফ্রি টাইমের পর বাংলাদেশমুখি বা বাংলাদেশি পণ্যের ইউরোপমুখী কনটেইনার সময়মতো জাহাজে বোঝাই না হলে দিতে হয় চার্জ। আর ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জট থাকলে আমদানি-রফতানি পণ্য পেতে দেরি হয়ে যায়। কিন্তু সরাসরি পণ্য আমদানি হলে বাড়তি কোনো চার্জ লাগবে না। উল্টো নির্ধারিত সময়ে পণ্য আমদানি হবে চট্টগ্রাম বন্দরে। আবার রফতানি পণ্যও নির্ধারিত সময়ে বিদেশি ক্রেতারা গ্রহণ করতে পারবে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ সময়ের আলোকে বলেন, পাকিস্তান থেকে সরাসরি পণ্য নিয়ে কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসায় অনেক লাভ হয়েছে। প্রথমত কনটেইনার প্রতি ভাড়া কমেছে। দ্বিতীয়ত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মতো আমদানি পণ্য বন্দরে পৌঁছাতে সময় ক্ষেপণ হয়নি। তৃতীয় সুবিধা হচ্ছে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে ফিডার জাহাজ বোঝাইয়ের আগ পর্যন্ত কনটেইনার ওঠানামা কনজেশন চার্জ প্রদান। এসব কিছু থেকে মুক্তি পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমরা শিপিং এজেন্টরা চাই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর এড়িয়ে সরাসরি পণ্য আমদানি-রফতানি করতে। তাই আমাদের প্রত্যাশা-যেসব দেশ থেকে সম্ভব হয় এমন সব দেশ থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল হোক। তাতে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। ব্যয় সাশ্রয় হবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন সময়ের আলোকে বলেন, করোনার সময় বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে সরাসরি পণ্য রফতানি হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত পণ্য না থাকায় সরাসরি রফতানি নিয়মিত করা যায়নি। এই পথে আবার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি হচ্ছে। 

সরাসরি জাহাজযোগে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানি হলে কনটেইনার পিছু কত টাকা ব্যয় কমবে-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, কনটেইনার পরিবহন ভাড়া একেক সময় একেক রকম। আবার কনটেইনার জাহাজগুলো ধারণ ক্ষমতার সমান পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এলে ভাড়া এক রকম হবে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কনটেইনার কম নিয়ে এলে ভাড়া আরেক ধরনের হবে। তবে সরাসরি পণ্য নিয়ে এলে ভাড়া প্রতি কনটেইনারে অবশ্যই কম পড়বে। পাকিস্তান থেকে সরাসরি আসা জাহাজের কনটেইনার পরিবহন ভাড়া এক থেকে দেড় হাজার মার্কিন ডলার কম পড়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে এসব কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হলে পরিবহন ব্যয় আরও বেশি হতো।

গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) ভেড়ে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে আসা জাহাজ ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামে একটি কনটেইনার জাহাজ। পানামার পতাকাবাহী এই জাহাজে ২ হাজারেরও বেশি কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা। কিন্তু কনটেইনার নিয়ে আসে ২৭০টি।  বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমবারের মতো সরাসরি জাহাজ আসায় হইচই পড়ে যায়। এই জাহাজ ঘিরে নানা গুজব ছড়ায় দ্রুত। জাহাজে অস্ত্র থাকা ছাড়াও জাহাজটির পণ্য পরীক্ষা করতে চাওয়ায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। পরে জাহাজের ইম্পোর্ট জেনারেল মেনিফিস্ট বা আইজিএম থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, কনটেইনার ভর্তি করে আমদানি হয়েছে শিল্পের কাঁচামাল পেঁয়াজ আলু খেজুরসহ নানা ধরনের পণ্য। কোনো পণ্যই নিষিদ্ধ ছিল না। জাহাজটি ১৪ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করলেও এখনও সরব আলোচনা হচ্ছে সরাসরি জাহাজ আসা নিয়ে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম সময়ের আলোকে বলেন, তৃতীয় দেশ ঘুরে বা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে নিয়মিত পণ্য আমদানি হচ্ছে। সারা বছরই আমদানি হচ্ছে পণ্য। কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর ঘুরে আমদানি হওয়ায় ব্যয় বেশি পড়ছে। আবার সরবরাহ পৌঁছে দেরিতে। দ্রুত এবং কম পরিবহন ব্যয়ে আমদানি অব্যাহত রাখতে সরাসরি জাহাজ চলাচলের বিকল্প নেই। পাকিস্তান থেকে নিয়মিত পেঁয়াজ আমদানি হয়। পাশাপাশি মসলা, ভুট্টা এবং খেজুরও আমদানি হয়। এসব পণ্য অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্য পণ্য।

সরাসরি আর কোন দেশ থেকে পণ্য আমদানি হয়-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান ছাড়াও সরাসরি ব্রাজিল থেকে পণ্য আমদানি হয়। বাল্ক কার্গো জাহাজে করে ওইসব দেশের পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর আসে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ পৌঁছতে ৩০ দিন লেগে যায়। সে ক্ষেত্রে নিকট দূরত্বের বন্দর থেকে পণ্য সরাসরি আমদানি হলে সব দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। 

কাস্টমস সূত্র জানায়, পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজে করে ছয় হাজার ৩৩৭ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। পাকিস্তানের ১৮টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য সরবরাহ করেছে। গত ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান মতবিনিময় সভায় পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ আসায় প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, সরাসরি জাহাজ আসায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। এভাবে পণ্য আমদানির মাধ্যমে দেশের ব্যবসা খাত লাভবান হবে। 

সরাসরি কনটেইনার রফতানি বন্ধ
২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালি পর্যন্ত সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চালু হয়। ওই দিন দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-৪ জেটি থেকে ইতালির পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’ কনটেইনারসহ ইুালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়।  প্রথমবারের মতো রফতানি পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দও থেকে সরাসরি ইতালির উদ্দেশে কনটেইনারবাহী কোনো জাহাজ ওইদিন যাত্রা করে। জাহাজটির ইুালির রেভেনা বন্দরে  পৌঁছাতে সময় লাগে ১৭ দিন। জাহাজটি ৯৫২টি রফতানি পণ্যের কনটেইনার নিয়ে গিয়েছিল ইতালিতে।  

শিপিং এজেন্ট সূত্র জানায়, এমভি সোঙ্গা চিতা এবং এমভি কেপ ফ্লোরেস নামে দুটি কন্টেইনার জাহাজ ভাড়া করে ইতালিয়ান শিপিং কোম্পানি ক্যালিপসো কোম্পানি ডি নেভিগেশন এসপিএ। দুটি জাহাজের মধ্যে কেপ ফ্লোরেস জাহাজটি মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী। এটির গভীরতা ৮ দশমিক ৬৬ মিটার। কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ২শ’ (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে)। দৈর্ঘ্য ১৫৪ দশমিক ৪৭ মিটার এবং প্রস্থ ২৫ দশমিক ১৯ মিটার। আর লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী ৬ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের সোঙ্গা চিতা জাহাজটি ১৪৮ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৩ মিটার প্রস্থ। কেপ ফ্লোরেস খালি কন্টেইনার নিয়ে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। কিন্তু ফিরতি পথে এটি কোনও রফতানি কন্টেইনার নিয়ে যায়নি। পরীক্ষামূলক যাত্রা হওয়ায় কোনও কন্টেইনার নেওয়া হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত এই রুটে সরাসরি কন্টেইনার পরিবহন স্থায়ী করা যায়নি। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, সরাসরি আমদনিতে দেশের ব্যবসা খাত লাভবান হবে। আমদানি-রফতানিতে যুক্ত ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। তবে সরাসরি পণ্য আমদানির মতো পর্যাপ্ত কার্গো পেলেই জাহাজ আসবে চট্টগ্রাম বন্দরে। অন্যথায় তৃতীয় দেশ ঘুরে বা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে ব্যবসা অব্যাহত রাখা ছাড়া বিকল্প নেই।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close