প্রিয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় চড়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটা সময় সবার কাছেই শখের বিষয় ছিল। কিন্তু এখন রিকশায় ব্যাটারি যুক্ত করায় সেগুলোর দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, রাজধানীতে জনভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর ধরনেও এসেছে পরিবর্তন।
পুরোনো প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে যান্ত্রিক করা হচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে রিকশাচালকদের মধ্যে বাড়তি টাকা উপার্জনের প্রতিযোগিতা। এমনকি মূল সড়কেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। ঢাকার মূল সড়কও এখন তাদের দখলে। তাদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ভোগান্তি, ঘটছে দুর্ঘটনা। এমনকি এসব দুর্ঘটনা কখনো কখনো কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ।
ব্যাটারিচালিত রিকশার এ নৈরাজ্য ঠেকাতে কিছু নীতিমালা প্রণয়নসহ এগুলোর উৎপাদন ও আমদানি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে মঙ্গলবার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এ আদেশ বাস্তবায়ন করতেও জোড়ালোভাবে বলা হয়েছে। আদেশের পর বুধবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা।
গতকালও সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাজধানীর মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, রামপুরা ও ডেমরা এলাকায় রিকশাচালকরা জড়ো হন। এতে এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়া রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন করায় ঢাকা থেকে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধের এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি ও আশপাশের কয়েক জায়গায় ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। তখন পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষ, দোকানি, পথচারী, অটোরিকশা, বাসচালক ও হেলপাররাও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রিকশাচালকদের ধাওয়া করেন।
গত মঙ্গলবার নিজ ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় নিহত হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্রী আফসানা রাচি। তিনি রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাকে জাবির মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুধু রিচির মৃত্যুই নয়, ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় অনেক সম্ভাবনাময় জীবন ঝরে যাচ্ছে অকালে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ইজিবাইক, অটোরিকশা, অটোভ্যান, মিশুক, লেগুনা ও টেম্পুর এক হাজার ৭৬১টি দুর্ঘটনায় ১৭০ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের দুই দশমিক ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, গত ১১ বছরে (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সড়ক দুর্ঘটনায় যানবাহনের মধ্যে শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও অটোভ্যান ৮ হাজার ১২৫টি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, যা মোট দুর্ঘটনার ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
প্রতিদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে অভিযান চালালেও তা কাজে আসছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তারা জানান, এ ধরনের রিকশা বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চালায় ঠিকই; কিন্তু কিছু দিন পর আবারও নতুন করে তারা রাস্তায় নামে। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কয়েক দফা অভিযান চালালেও থেমে নেই অবৈধ এসব বাহনের দৌরাত্ম্য। বুয়েটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানের ঢাকায় প্রায় ৫০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর মূল সড়কের চেয়ে অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেশি। সুযোগ পেলে মূল সড়কেও দাপিয়ে বেড়ায় এসব রিকশা। রাজধানীর প্রায় সর্বত্র ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল রয়েছে। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হচ্ছেন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার নাজমুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা ও ইজিবাইক বন্ধে আমাদের কার্যক্রম চলমান। সড়কে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেওয়া যাবে না। মহানগর এলাকার সব ট্রাফিক পয়েন্টে বিশেষভাবে তদারক করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার জন্য। যেখানে যে যানবাহন চলার কথা সেখানে তাই চলতে হবে। অন্যথায় মামলা ও জরিমানার শিকার হতে হবে। প্রতিদিনই ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ অভিযান পরিচালনা করছে।
তিনি আরও বলেন, এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে যাত্রীদের ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকগুলোতে না ওঠার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। রিকশা যেন মূল সড়কে চলতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাত্রীরা যদি তাদের এড়িয়ে চলেন তা হলে কাজটি করতে সহজ হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোকে আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা উল্লেখ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে এসব যানবাহন যে হারে বেড়েছে তা রাতারাতি বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। এগুলো বেড়ে ওঠার সময়ই দমিয়ে রাখা দরকার ছিল। এখন সমস্যাটা অনেক জটিল হয়ে গেছে। ঢাকার মতো মেগা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেওয়া যাবে না। প্যাডেলচালিত রিকশার মধ্যে ব্যাটারি লাগিয়ে চালানো মানে ঝুঁকি তৈরি করা। যারা এসবের দায়িত্বে আছেন তাদের আরও কৌশলী হতে হবে। আর যেভাবেই হোক তাদের মূল সড়ক থেকে সরাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রিকশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কিছু নীতিমালা দরকার, যা বৈজ্ঞানিকভাবে সম্মত হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন আর জন্ম হতে না পারে সে জন্য উৎপাদন ও আমদানিও বন্ধ করতে হবে।
সময়ের আলো/আরএস/