গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোথাও কার্যকর নেই। বিচার বিভাগের আজকের অবস্থা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা। যদি মানুষ অনুভব করে যে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়, তা হলে রাষ্ট্রে সেই বিচার বিভাগের কোনো আস্থার স্থান থাকে না। বিচার বিভাগের প্রতি কোনো সরকারই কখনো যথার্থ নজর দেয়নি। ফলে বিচার বিভাগ সরকারের সবচেয়ে দুর্বলতম বিভাগে পরিণত হয়েছে।
বুধবার সকালে প্রেস ক্লাবে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ
পৃথককরণের ১৭ বছর’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। মিনৌরি বাংলাদেশের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’ এবং মাসিক আইন ও বিচার-এই মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে।
হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন আইন সংস্কার কমিশনের সদস্য মাজদার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার, জেলা জজ ও সংবিধান আলোচক ইকতেদার আহমেদ, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির, বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. খাদেমুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শাকিল আহমেদ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. পারভেজ।
অনুষ্ঠানে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানে দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। একই সঙ্গে অধস্তন আদালতের সুষ্ঠু তদারকির স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে অবিলম্বে পৃথক সচিবালয় চালু, মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল সংশোধন তথা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সচিবালয় থেকে সংসদে স্থানান্তর, বিচারকদের নিয়মিত বদলি, বিচারক নিয়োগে দৃশ্যমান অনুসরণযোগ্য নিয়মকানুন প্রণয়ন ও সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগের উদ্যোগসহ আইনশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানোরও সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আইনজীবীরা বিচারকদের বিচারিক কার্যক্রমের সহযোগী। কোর্টে বেঞ্চ আর বার একই মুদ্রার দুই পিঠ। এ জন্য এই দুই অংশকে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সাজাতে হবে। তিনি বলেন, বিচারকদের মানসিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। তা না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাক্সিক্ষত ফল আনতে পারবে না। জুডিশিয়ারির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার এক্সেস। আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা নির্ধারণে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারে, কিন্তু স্বাধীনভাবে। কেবল বিচারকই নয় রায়ের গুণগত মানও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আইন সংস্কার কমিশনের সদস্য মাজদার হোসেন বলেন, পৃথক সচিবালয় স্থাপনের দাবি নিয়েই আমাদের সংগ্রাম। সেই দাবি থেকে আদৌ সরে যাইনি এবং এ দাবির প্রতি এখনও অটল রয়েছি। বিচার বিভাগ প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। এমন একটি অবকাঠামো তৈরি করতে হবে যেখানে বিচারকদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির কাছে অর্পিত থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সংবিধান আলোচক ইকতেদার আহমেদ বলেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ এখন আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে। তা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিতে হবে। তবে আগে সুপ্রিম কোর্টে তা নিয়ন্ত্রণের মতো অবকাঠামো ও পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিম্ন যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ আদালতে যারা বিচারক হিসাবে আসীন রয়েছেন তাদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির বলেন, মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বলেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়েছে। তাই সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্যই বিচার বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, ১৬ বছর নয়, ৫৩ বছরের অবিচার ধরে কথা বলতে হবে। বিচার বিভাগের সংকট কখনোই কাম্য না। আমরা জুডিশিয়ারি টাইরানি দেখেছি। আদালতে আইনজীবীদের বিচারকদের অন্যায় সহ্য করতে হয়, যা কাম্য নয়। মানুষ ৫৩ বছরের পরে হলেও কথা বলা শুরু করেছে। যা আমাদের ধরে রাখতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে থাকবে বলে ঘোষণা দিলেও কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজও সোনার হরিণ হয়েই আছে। তা ছাড়া দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই বিভাগ কোনো সময়ই সরকারের কাছ থেকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
সময়ের আলো/আরএস/