ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, লোকসান বাড়ছে বিপিডিবির
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ২:০৩ এএম  (ভিজিট : ১৩৬)
দেশে গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু ক্যাপটিভ (নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন) বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ থেমে নেই। বরং ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহে আগ্রহ বেশি বিতরণ কোম্পানিগুলোর। দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোতে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার অর্ধেকের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয় ক্যাপটিভে।

ক্যাপটিভে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তা দিয়ে কম্বাইন্ড সাইকেলে গ্যাস সরবরাহ করা হলে প্রায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি পাওয়া সুযোগ রয়েছে। দেশের কূপ থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস পাওয়া যায় ১ টাকা দরে, আর একই পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে ৭১ টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে। এই দামি গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় একদিকে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, অন্যদিকে লোকসানের বোঝা বাড়ছে বিপিডিবির।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভে কমবেশি ৪ মেগাওয়াট (৪ হাজার ইউনিট) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, একই পরিমাণ গ্যাসে কম্পাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। অর্থাৎ একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে দেড়গুণ বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এরপরও একের পর এক ক্যাপটিভের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩১০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ার সুর তুলে ক্যাপটিভেই ঝুঁকছেন শিল্প মালিকরা। শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহে নয়-ছয়ের অভিযোগও রয়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সূত্র জানিয়েছে, জুন ২০২৪ পর্যন্ত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৬ হাজার ৮৫ মেগাওয়াট দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক রয়েছে ৩ হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট। আর ডিজেলভিত্তিক রয়েছে ২ হাজার ৬২৫ মেগাওয়াট। বিইআরসি বলছে, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের হার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৭টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৫টি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫৯টি সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩১০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে মোট ৯ হাজার ৭২৪ মিলিয়ন ঘনমিটার, একই সময়ে ক্যাপটিভে ৫ হাজার ৩১০ মিলিয়ন ঘনমিটার। ১৮ নভেম্বর (২০২৪) বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯২৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। আর ক্যাপটিভে মাত্র ১০৩ মিলিয়ন ঘনফুট অর্থাৎ ৯ ভাগের একভাগ।

তবে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা ছয়টি কোম্পানির বার্ষিক রিপোর্ট বলছে ভিন্ন কথা। সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের ২০২২-২৩ অর্থবছরের রিপোর্টে গ্যাস বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ওই বছর কোম্পানিটি ৩ হাজার ২৮৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস দিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আর ক্যাপটিভে সরবরাহ দিয়েছে ৪ হাজার ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কর্ণফুলীর রিপোর্টও বলছে ক্যাপটিভে বেশি সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৭২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ক্যাপটিভে আর বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে ৫২২ মিলিয়ন। তবে জালালাবাদ ও বাখরাবাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে। ছয়টি কোম্পানির দৈনিক গড় সাড়ে ২৬ মিলিয়ন (বিদ্যুৎকেন্দ্র) ও সাড়ে ১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার (ক্যাপটিভ)। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে ক্যাপটিভে।

পিডিবি সূত্র বলছে, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে বিতরণ কোম্পানির অবহেলার শিকার হচ্ছে দক্ষ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো ক্যাপটিভে গ্যাস দিলে বেশি দাম পান, তাই সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে ক্যাপটিভে দিতে তাদের আগ্রহ বেশি। এ ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে শিল্প কারখানায় অতিরিক্ত গ্যাসের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। রয়েছে গ্যাস চুরির অভিযোগ। ক্যাপটিভে ১০ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাস ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো এই বাধ্যবাধকতা এড়াতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভুয়া গ্রাহক সংকেত দিয়ে লোড বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়ায় অবস্থিত এনআর গ্রুপকে ভিন্ন তিনটি গ্রাহক সংকেত দিয়ে ২৪ দশমিক ৯২ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ দেওয়া হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে। এভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে অনেকেই সংযোগ পেয়েছেন।

শিল্প মালিকদের বক্তব্য হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সে জন্য আলাদা বিনিয়োগ করে ক্যাপটিভ স্থাপন করে নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন। তারপরও গ্যাসের অভাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্যাপটিভ সংযোগের ক্ষেত্রে তিতাস গ্যাস ও কর্ণফূলী গ্যাসের ভূমিকা বেশি সমালোচিত। কঠোরভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা থাকলেও শত শত ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে কোম্পানি দুটি। কখনো বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে, কখনো বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই। দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানি দুটির বোর্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবরা। তাদের কাছে লবিং-তদবির করে দেদার অনুমতি বাড়িয়ে নিয়েছেন শিল্প মালিকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপটিভে গ্যাসের অপচয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকায় ঘাটতি বাড়ছে বিপিডিবির। এভাবে চলতে থাকলে এতে বিদ্যুৎ খাত সংকটে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ক্যাপটিভের চেয়ে কম্বাইন্ড সাইকেলে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু শিল্প মালিকরা চান তারা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন। এটি একটি বিরাট সমস্যা। কারণ দেশে গ্যাস সংকট রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকছে। ভবিষ্যতে গ্যাস থাকবে না।

তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে। প্রত্যেক দেশে গ্রিড ব্যবহার করা হয়। শিল্প মালিকরা গ্রিড বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেই পারে। সে জন্য তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি বলেন, ক্যাপটিভে যে গ্যাস দেওয়া হয় তা দিয়ে ১৬ শতাংশ বেশি গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে আমাদের সমস্যা আর থাকে না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও তা এগোয়নি।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close