পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে সেসব দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্র সচিব। সেসব অঞ্চলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কী কী চ্যালেঞ্জ এবং তা উত্তরণের পথ কী সেগুলো নিয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। পূর্ব ইউরোপের সম্ভাবনাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পূর্ব ইউরোপ এবং সিআইএস দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে গত ১৩ নভেম্বর পররাষ্ট্র সচিব ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এক বৈঠক করেন। বৈঠকে পূর্ব ইউরোপ এবং সিআইএস দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, প্রবাসীদের কল্যাণ এবং ওইসব দেশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওইসব দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং যারা কাজ করতে যেতে চান তাদের চ্যালেঞ্জগুলো বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে আলোচন করা হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কনস্যুলার সেবা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দূতদের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি বাড়াতে, কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মোটা দাগে বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে এখনও শতভাগ সম্পর্ক গড়তে পারেনি। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন ভিন্ন রকমের। ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ মূলত সমাজতান্ত্রিক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রোমানিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, গ্রিস এবং উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে। এর মধ্যে গ্রিস ও তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) রাষ্ট্র। বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, কসোভা- পূর্ব ইউরোপের এই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এখনও সরাসরি সম্পর্ক গড়তে পারেনি। যদিও কসোভো ঢাকায় দূতাবাস চালু করেছে এবং হাঙ্গেরি ঢাকায় একটি অস্থায়ী ভিসাকেন্দ্র চালু করেছে। যে কোনো অঞ্চলের শতভাগ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাইলে সেসব স্থানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অনেক রাষ্ট্রই নিকট ভবিষ্যতে ইইউভুক্ত হয়ে যাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আগেভাগেই সম্পর্ক গড়তে পারলে এবং পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে গেলে তখন বাংলাদেশ বেশি সুবিধা পাবে।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের যেসব সম্ভাবনা রয়েছে তার মধ্যে জনশক্তি রফতানি এই সময়ের মূল বিষয়। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে জনসংখ্যা খুব কম, বিশেষ করে সেখানে তরুণ জনগোষ্ঠীর খুব অভাব। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর যোগ্য তরুণ কর্মীরা সরাসরি ইউরোপে গিয়ে কাজ করে। যে কারণে সেখানে তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর চাহিদা প্রচুর, যা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণ জনশক্তিকে দক্ষ করে সেখানে পাঠাতে হবে। অদক্ষ বা মানব পাচার প্রক্রিয়ার আদলে জনশক্তি রফতানি করলে তা বুমেরাং হবে। এরই মধ্যে মাল্টা ও রোমানিয়ায় অদক্ষ বা মানব পাচার প্রক্রিয়ার আদলে জনশক্তি রফতানি করে বাংলাদেশ বদনাম কামিয়েছে। বছর দুই আগেই রোমানিয়া দক্ষ জনশক্তি নেওয়ার জন্য বাংলাদেশে ক্যাম্প অফিস চালু করেছিল কিন্তু সঠিক পন্থা অবলম্বন না করায় পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে ক্যাম্প অফিস গুটিয়ে নেয় রোমানিয়া।
এই অঞ্চল থেকে আশপাশের অঞ্চলে শ্রমের মূল্য বেশি হওয়ায় বাংলাদেশিরা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে যায়। তাই সেখানে জনশক্তি রফতানির আগে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে এবং এমন উদ্ভাবনী শক্তি বের করতে হবে যাতে কেউ সেখানে গিয়ে আবার পালিয়ে অন্য জায়গায় না যায়। এছাড়া গোটা ইউরোপে যেভাবে ডানপন্থিদের উত্থান ঘটছে তাতে মূল ইউরোপ ভূখণ্ডে বাংলাদেশিদের কাজ করতে যাওয়ার পথ নিকট ভবিষ্যতে কঠিন বা বন্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপকে এখন থেকেই মাথায় রাখলে ভবিষ্যতে বেকায়দায় পড়তে হবে না।
শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশিদের জন্য সঠিক গন্তব্য। সেখানে বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় মানের প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হাঙ্গেরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মেধাবী হিসেবে পরিচিত। সেখানে ২০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হাঙ্গেরি সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। তবে পূর্ব ইউরোপের সবগুলো দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভিসা পেতে ভোগান্তি হয়। ভারত অথবা তৃতীয় অন্য দেশের মাধ্যমে ভিসা প্রক্রিয়া সারতে হয়। ভিসা প্রক্রিয়া ভোগান্তিবিহীন করতে সরকারের দিক থেকে বিকল্প কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে এখনই ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করা সম্ভব নয় তবে সম্ভাবনা আেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। মূলত এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে এখনও বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য বা বিনিয়োগের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ এখনও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর বন্দর ব্যবহার শুরু করেনি। বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য সেখানে যায় তা জার্মানি ও ফ্রান্সের বন্দর দিয়ে তৃতীয় মাধ্যমে যায়। সরাসরি পাঠাতে হলে সেখানকার বন্দর ব্যবহার করতে হবে। সিআইএসভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করতে ৬/৭ বছর আগে বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলেও এখন তা থমকে আছে। সেখানে তৈরি পোশাক, সিরামিক ও পাটসহ বাংলাদেশি একাধিক পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়া থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ জন ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছে। কিন্তু দিল্লিতে অবস্থিত বুলগেরিয়ার দূতাবাস থেকে ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার কোনো ডেট পাচ্ছেন না। আজ পাঁচ মাস ধরে আমরা ৬০০ কর্মী ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আপনাদের (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ভিসা না হলে আমরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হব।
ফারজানা শান্তা নামের একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা পাওয়ার জন্য আমাদের বাংলাদেশের জনগণের ইন্ডিয়া-নেপাল ছাড়া কোনো গতি নেই। লাখ টাকা খরচ করে ২/৩ মাস ইন্ডিয়া-নেপাল গিয়ে থাকতে হয় শুধু ইউরোপের ভিসা পাওয়ার জন্য। তার ওপর রিজেক্ট এলে শুধু শুধু দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নষ্ট করতে হয়। এরকম করে আর কত! স্যার ইউনূসের ওপর আস্থা আছে বলেই আমরা তার কাছে দাবি করছি। তিনি যেন আমাদের জন্য ইউরোপ যাওয়ার পথ সহজ করে দেন, যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা যেন ভবিষ্যতে না করতে হয়, লাখ টাকার লস আর কোনো ইউরোপগামী ভাইবোনদের যেন করতে না হয়, এটাই আমরা চাই।
সাবেক একজন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু লোভী একদল গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই সম্ভাবনাকে মিসইউজ করছে। এই বিষয়গুলো সরকারের উপরের মহলও অবগত। এমন নেতিবাচক কাজকর্ম চিহ্নিত করে এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনে এই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই মরে যাবে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান একসময় পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ডে বাংলাদেশের নিযুক্ত দূত ছিলেন।
তিনি দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো নিয়ে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী না হওয়াই ভালো। সেখানে খুব বেশি সম্ভাবনা নেই। সেখানকার অর্থনীতি, বাজার এবং জনসংখ্যা বেশি বড় না। তবে সেখানকার সম্ভাবনাগুলো এখনও ব্যবহৃত হয়নি। বাংলাদেশ মূলত বাইরের বিশ্বকে পশ্চিমা চোখ দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত। এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারলে এবং ভিন্ন চোখে দেখতে পারলে পূর্ব ইউরোপে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন কসোভোর সঙ্গে এখন থেকেই যোগাযোগ শুরু করলে সামনে সুবিধা পাওয়া যাবে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানির সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। অদক্ষ কর্মী বা মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি করলে সুযোগ নষ্ট হবে। কর্মীদের রফতানির আগে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বা অনিয়মিতভাবে বা অবৈধপথে বিদেশ যাত্রা বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং এই খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নেতিবাচক কাজ বন্ধের উদ্যোগ না নিলে পাচারকারীরা সব সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেবে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে যাওয়ার হাইপ চলছে। এর পেছনের মূল বিষয় হচ্ছে সেখান থেকে পালিয়ে ইইউভুক্ত দেশে প্রবেশ করা। আবার যারা যাচ্ছে তাদেরও কোনো দক্ষতা নেই। অথচ এই সময়ে বিশ্বে অদক্ষ কর্মীর কোথাও জায়গা নাই। আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ বানাতে হবে। মানব পাচারকারীদের ঠেকাতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ৯০ থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত সময়ে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়ায় ইলেকট্রনিক ও পোশাক খাতের টপ ব্যবসায়ী ছিলেন বাংলাদেশিরা। অর্থাৎ সেসব জায়গায় আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হলে সব খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে সরকারকে পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে।
সময়ের আলো/আরএস/