দেশের আর্থিক খাত ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাল্টিপারপাস হলে 'অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থ বিভাগের সচিব, ব্যাংকিং ডিভিশনের সচিব এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) সচিব উপস্থিত ছিলেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ ও প্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার।
তবে অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া সবধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। সবধরনের গাড়ি কেনা বন্ধ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে রাজস্ব বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। এটা করা না গেলে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব পুনরায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।
এ সময় ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গেও কথা বলেন সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে আইন অমান্য করাই ছিল ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখভালেরও ঘাটতি ছিল। যে কারণে ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কিছু দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। তবে কোনোভাবেই কোনো ব্যাংক বন্ধ করা হবে না।
বাজারে মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, মূলস্ফীতি তো একদিনে হয়নি। এর আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে; যা মূলস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পে অহেতুক খরচ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু করার ফলে মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে, তবে এর সুফল এখনও আর্থিক খাতে যুক্ত হওয়া শুরু হয়নি। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি পণ্যের শুল্ক কমিয়েছে সরকার; যা আগামী রমজান মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। বাজারে গেলে আমারও দুঃখ লাগে: দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতি নিয়ে নিজের খারাপ লাগার কথা
জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, আমরা মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলি। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে ধৈর্য ধরা কঠিন। তিনি বলেন, এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে অল্প কিছু বাজার করা যায়। আমিও সেটা টের পাই, আপনারা সবাই টের পান। আমিও তো বাজারে যাই, আমারও দুঃখ লাগে। সাধারণ মানুষের জ্বালা আছে, তারা সেটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি আমাদের পীড়া দেয়। আরেকটা সমস্যা জ্বালানির দাম। আপনারাও জানেন আদানির (ভারতীয় কোম্পানি) একটা দাবি ছিল ৭০০ মিলিয়নের। আদানিকে ২০০ মিলিয়ন দেওয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের পাওনা বকেয়া ছিল, ওরা বলেছে সার দেওয়া বন্ধ করে দেবে। বকেয়া পরিশোধ করার পর এখন সার দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বকেয়া পাওনা। এটিকে কমিয়ে এনেছি। এখন ৪০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পাওনা আছে। এক টাকাও রিজার্ভ থেকে খরচ করা হয়নি। আগে রিজার্ভ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার, হুট করে ১২ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। আর্টিফিসিয়ালি রিজার্ভ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এগুলো অকল্পনীয় বিষয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি একদিনে হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমপ্লেক্স ফ্যাক্টর (জটিল বিষয়)। আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছেন। তারপর পাবলিক সেক্টরে বড় বড় প্রজেক্টে খরচ করেছেন, ওটার আউটপুট তো আসে না। পদ্মা সেতুর যাত্রা শুরু হয়েছে, এটির সুফল দক্ষিণবঙ্গ পাঁচ বছর পর পাবে।
তিনি বলেন, আমাদের সাপ্লাই চেইনটা এখন ঠিক রাখতে হবে। আমরা এনবিআর থেকে পেঁয়াজের শুল্ক কমিয়ে দিয়েছি। আলুর শুল্ক কম। চিনির শুল্ক কমানো হয়েছে। কয়েক দিন আগে চালের শুল্কও কমানো হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা সার, চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, রোজার খেজুরের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছি। এসবের জন্য এলসি মার্জিন জিরো (শূন্য) করে দিয়েছি।
বন্ধ হবে না কোনো ব্যাংক : অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক খাতের যেসব খারাপ সিনড্রোম ছিল সেগুলো কারেকশন হচ্ছে। কিছু ব্যাংক দুরবস্থা কাটিয়ে ফিরে আসছে। ইসলামী ব্যাংক বড় ব্যাংক, এটি দুর্বলতা কাটিয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কিছু ব্যাংক খুঁড়িয়ে চলবে, তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ করার ইচ্ছা সরকারের নেই। এটি আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ব্যাংক খাতে হারানো আস্থা ফেরানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।
তিনি বলেন, ভালো ব্যবসায়ীদের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ফেরত দেন এবং ঠিকমতো কর দেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। তারাই ভীত, যারা বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে অনেক কিছু করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক এ প্রসঙ্গে বলেন, যেসব দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তারা যেন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারে সেজন্য দ্রুত উদ্যোগ দেখা যাবে।
কমবে বাজেট ব্যয় : বাজেটের ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) কোন কোন প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাজেটের ব্যয় কমানো হবে। তবে সরকারি কর্মকর্তা যারা আছেন তাদের বেতন-ভাতা আটকাবে না।
তিনি বলেন, আমাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) সাফল্যের সূর্য উদয় হয়েছে এবং আমাদের অর্জন খুব একটা খারাপ নয়। আমরা একটি পায়ের ছাপ রেখে যাব। আমরা এমন জায়গাগুলো দিয়ে হাঁটব যেখানে রাস্তা তৈরির দিক নির্দেশ করবে। আমরা কিছু সংস্কার করে যাব। পরবর্তীকালে যারা আসবেন তারা বুঝবেন যে এখান থেকে রাস্তা তৈরি করতে হবে। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ডিসেম্বরের মধ্যে মিলবে ১১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ : এদিকে সংবাদ সম্মেলনে অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার জানিয়েছেন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬০০ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পলিসি নিচ্ছে, এগুলোর ব্যাপারে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ব্যাপক সমাধান দিয়েছে। আমাদের প্রকৃত যে প্ল্যান ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা পাচ্ছি।
অর্থ সচিব বলেন, এরই মধ্যে এডিবির সঙ্গে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এই অর্থ আমরা পাব। বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। এটিও ডিসেম্বরের মধ্যে পাব। এ দুইটি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক ছিল ৩০০ ও ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তার মানে দুটিই আমরা ডাবল ডাবল করে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আইএমএফের কাছে অতিরিক্ত সহায়তা চেয়েছি। এরমধ্যে এ বছর আমরা অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার চেয়েছি। আগামী ৪ ডিসেম্বর আইএমএফ (প্রতিনিধি দল) আসবে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা কওে চূড়ান্ত হবে। যে প্রগ্রেস দেখছি, আমরা আশাবাদী এটি আমরা পাব।
খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আরও সক্রিয় করা হবে
খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হবে কি নাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে করা হলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আরও সক্রিয় করা হবে। তবে গভর্নরকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের রিট মামলা নিষ্পত্তির জন্য দুটি বেঞ্চ রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ও গভর্নরের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে, যেন এই বেঞ্চগুলো আগামী তিন মাস শুধু রিট মামলাগুলো পরিচালনা করেন।