রাজধানীর পল্লবীতে বাবার হাতে দুই শিশু সন্তানের খুনের ঘটনা এখন টক অব দ্য টাউন। সম্প্রতি সাত ও চার বছর বয়সি দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যার পর বাবাও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পুলিশ ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ধারণা যাচ্ছে, আর্থিক অনটন ও ঋণগ্রস্ততার হতাশা থেকে তিনি সন্তানদের খুন করে থাকতে পারেন। আর্থিক সংকটজনিত এই হতাশাকে মা-বাবার হাতে সন্তান খুনের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়।
গত ৪ জানুয়ারি রাতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাড়ি ইউনিয়নের ধলবাড়িয়া গ্রামে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের জের ধরে ৮ বছরের আরিফ হোসেনকে হত্যার পর ঘর জ্বালিয়ে দেন বাবা ইয়াসিন আলী গাজী। ২৪ জানুয়ারি বগুড়ার শিবগঞ্জে মিষ্টি খাওয়াকে কেন্দ্র করে বাবার হাতে ফারাজ আলী খুন হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার রামবল্লভ গ্রামে আট বছরের শিশু মরিয়মকে হত্যা করেন মা রিনা বেগম। ১৮ জুন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নিজের সাত দিনের নবজাতক তাসনিদ উসমানকে একটি ভবনের নয় তলা থেকে ফেলে হত্যা করেন তৃষা আক্তার (২৪)। স্বামী দ্বিতীয় সন্তান নিতে না চাওয়ায় এই নির্মম হত্যা। আবার সমাজ-স্বীকৃত নয়, বাবা কিংবা মায়ের এমন সম্পর্কের জেরেও সন্তান হত্যার ঘটনা ঘটছে।
মানুষ, সমাজ, রাজনীতি ও মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষকরা মনে করছেন; দ্রুত পাল্টে যেতে থাকা সমাজে দ্রুততম সময়ে মূল্যবোধের বদল এবং পুরোনো সমাজ ও মূল্যবোধের সঙ্গে এর দ্বন্দ্ব এসব খুনের নেপথ্যে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। তাই এসব খুনের দায় এককভাবে হত্যাকারী ব্যক্তির ওপর বর্তায় না। উচ্চাধুনিক পুঁজিবাদ আমাদের সামাজিক সম্পর্কে যে নির্মম চাপ তৈরি করছে, তা এসব খুনের নেপথ্যে জোরালো ভূমিকা পালন করছে। তাই এসব ঘটনায় পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের দায় অস্বীকার করা যায় না।
পল্লবীর বাইগারটেকের বেপারীপাড়া এলাকায় বাবার হাতে দুই শিশু সন্তান খুন হয় ১৬ নভেম্বর। পুলিশ ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক অনটন ও ঋণগ্রস্ত হওয়ায় হতাশায় ভুগছিলেন বাবা আহাদ মিয়া। এ নিয়ে নিয়মিত পারিবারিক কলহ বাঁধত সংসারে। বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছুরি দিয়ে দুই শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যার পর নিজেও নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আহাদ। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে জেনেছি পারিবারিক কলহের জেরেই এই হত্যা। এ ছাড়াও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সম্পর্কজনিত দ্বন্দ্বের কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা নিত্রা এ ব্যাপারে দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, নানা কারণে এই ধরনের কাজ করে থাকে মানুষ। সমস্ত সম্পর্কই অনেক বৈশ্বিক এবং বস্তুগত। যেকোনো কিছুর সঙ্গে অর্থ-সম্পত্তি থাকা না থাকার জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। সমাজ যখন দ্রুত পাল্টায় তখন নানাভাবে তার প্রভাব পড়ে। পরিবারের ওপর এই যে প্রভাবগুলো দেখা যাচ্ছে, তা সেই বড় পরিবর্তনেরই এক ধরনের প্রতিক্রিয়া।
২১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মেয়ে ইয়াসমিন আক্তার বৃষ্টির (১৪) গলা কেটে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বাবা বুলু। স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত সন্দেহে ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েকে খুন করেন তিনি। ১০ মার্চ বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে পরিকল্পিতভাবে মায়ের হাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুই শিশু খুন হয়। এ ঘটনায় শিশু দুটির বাবার করা মামলায় মা লিমা আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা নিত্রা বলছেন, পারিবারিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং সমাজ এত দ্রুত পাল্টাচ্ছে যে সেই পাল্টানো সমাজের সঙ্গে আমাদের আগে থেকে শেখা পরিবার, প্রথা এবং তার যে মূল্যবোধ তার একটা সাংঘর্ষিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। একইভাবে নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ বলেন; বাবা-সন্তান, মা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী যেকোনো সম্পর্কের মধ্যে সামগ্রিক সম্পর্কগুলো প্রচণ্ড চাপে আছে। কেননা আমাদের বাজার এবং শোষণ কেন্দ্রিক যে অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এটার সঙ্গে আমাদের সনাতন সমাজের মূল্যবোধ এবং মানবিক দিকগুলো টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ফলে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে।
৪ মার্চ পারিবারিক কলহের জেরে যশোরের চৌগাছায় বাবা-মায়ের হাতে সাইমন ওরফে রেজাউল নামে এক সন্তান প্রাণ হারায়। ১৫ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগ বউবাজার এলাকায় খাবার খেতে না চাওয়ায় বাবার হাতে পাঁচ বছরের মেয়ে শিশু খুন হয়। ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় পাঁচ বছর বয়সি শিশুকন্যা মারিয়া সুলতানাকে কুপিয়ে হত্যা করে বাবা তাজুল ইসলাম। এদিকে গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মোল্লাপাড়া এলাকায় একটি বাসা থেকে বাবা-ছেলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আহত অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পেছনেও ছিল আর্থিক কারণ। জমি কিনে প্রতারিত এবং শেয়ার ব্যবসায়ও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চরম হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। হতাশা থেকেই সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন।
আধুনিক পুঁজিবাদ সামাজিক সম্পর্কের ওপর নানান ধারার চাপ তৈরি করছে বলে মনে করেন নৃবিজ্ঞানী বখতিয়ার আহমেদ। দৈনিক সময়ের আলোকে তিনি বলেন, উচ্চাধুনিক পুঁজিবাদ নামের যেই আধুনিক বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাতে আমরা আছি, তা আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্মম চাপ তৈরি করে। বাজারব্যবস্থায় নিত্যনতুন ভোগ্যপণ্যের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের চাহিদা-আকাক্সক্ষা বাড়তে থাকে। এভাবে সাংঘাতিক চাপ তৈরি হয়। সেই জায়গায় আত্মহত্যা যেভাবে বাড়ছে, এই ধরনের হত্যাগুলোও বাড়ছে। এটার জন্য আমরা যতই ব্যক্তি মানুষকে দায়ী করি না কেন, এটার কার্যকারণগুলো খুঁজতে হবে সামাজিকব্যবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে।
মানসিক ভারসাম্য হারিয়েও সন্তানকে হত্যার নজির রয়েছে। গত ৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকায় মায়ের হাতে ৯ বছরের কন্যা শিশু খুন হয়। ঘটনার দিন প্রতিবেশীদের বরাতে পুলিশ জানায়, নিহতের মা কেয়া চক্রবর্তী মানসিক ভারসাম্যহীন। এদিকে চলতি বছরের ১০ জুলাই মাদারীপুরে ঘরের দরজা ভেঙে তিন বছর ও এক বছরের দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দুই শিশুকে হত্যা করে পাশেই বসে ছিলেন মা। স্থানীয়রা জানান, চার বছর আগে বিয়ের কিছুদিন পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তাহমিনা।
পল্লবীতে দুই সন্তানকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি কোনো হতাশার লক্ষণ দেখা যায়, তার মধ্যে যদি মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দেয় বা বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দেয় তখন তাকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব নির্মমতা রুখতে মানসিকতার পরিবর্তনের ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, ‘এই জায়গাটিতে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যম তাদেরকে আমরা বলব বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক পল্লবীর সাম্প্রতিক হত্যা নিয়ে সময়ের আলোকে বলেন, এসব ঘটনায় রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। জনগণকে যেকোনো পরিস্থিতিতে বা জীবনের প্রশ্নে লড়াই-সংগ্রাম করে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা দিতে রাষ্ট্রের দিক থেকে যতটুকু প্রণোদনা থাকা উচিত, তা আমাদের এখানে নেই।