১৬ তারিখে শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনারে অবস্থান নেয়। আর ছাত্রলীগ তাদের ক্যাডার বাহিনী ও টোকাইদের নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। তখনই বোঝা হয়ে গেছে এ আন্দোলন সফলতার দিকে যাচ্ছে। আমি কোনো দলের শিক্ষক না, তবে আমাদের মনে যে দোলা দিল আমার শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে এসে মারধর করবে আমরা তো বসে থাকতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বিশেষত্ব হলো এদেশের সব আন্দোলনে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আমরা বলি এটা একটা স্যান্ডউইচ। যখনই তারা কোনো আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক হয়েছে তা সফল হয়েছে।
সফলতার হাতছানি দেখে মনোবল আরও দৃঢ় করে শিক্ষার্থীরা জুন থেকে আন্দোলনে থাকলেও ১৭ তারিখ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা এদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক হলো। ১৫ এবং ১৬ তারিখে আমরা শিক্ষকরা আলোচনা করছিলাম কী করতে পারি।
একপর্যায়ে আমরা ভাইস চ্যান্সেলর বাসভবনের গেটে ধাক্কানো শুরু করলে গেট খুলে দেওয়া হলো। আমরা কয়েকজন শিক্ষক ভেতরে যাই। একটু যাওয়ার পর প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল টিম আমাদের আটকে দেয়। এবং ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। তখন প্রক্টরের সঙ্গে হল বন্ধ নিয়ে কথা বলি। তখন উনাকে আমরা হল বন্ধের প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু সেদিন রাতেই হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
ততক্ষণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলশানে তারা রাজপথে নেমে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দারুণ ভূমিকা রাখে। অনেকে বলার চেষ্টা করছে কোটাবিরোধী আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের আন্দোলন ছিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, কোটা আন্দোলন শুধু কোটা নিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সবাইকে মাঠে নামিয়ে আনে।
আন্দোলনের শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বিসিএসের কোটা নিয়ে। এটি একটি সমাধান করা ইস্যু ছিল, পরে কোর্টে এ বিষয় নিয়ে আপিল হলে আলোচনা সামনে আসে। শিক্ষার্থীরা জুনে কোটা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। শিক্ষার্থীদের মনের ভাষা বুঝতে পারেনি। কেননা গণতান্ত্রিক সরকার মনের ভাষা বোঝে, চাপিয়ে দেওয়া নির্বাচনে বিজয়ী সরকার তা বুঝতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আন্দোলন দানা বাঁধছে, ১৫ তারিখে যে ঘটনাটা ঘটলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর বহিরাগতদের যে হামলা তা ৯০ সালে হয়নি। তার আগেও হয়নি। সেদিন ছাত্রলীগ টোকাইদের এনে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে হামলা করে। তার আগের দিন শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে যখন বললেন চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবে না তো কি রাজাকারের সন্তানরা পাবে- এটি শিক্ষার্থীদের আহত করেছে। এখানেও ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা কিন্তু বলেনি আমি রাজাকার, বলেছে যে রাজাকার সে স্বৈরাচার। আওয়ামী লীগ নেত্রী এই বিষয়টাকে সামাল না দিয়ে উসকানি দিয়েছে। আবার পার্টির সেক্রেটারি ছাত্রলীগ নামের গুন্ডা বাহিনীকে উসকে দিলেন, তখন তারা এর পরিণাম বুঝতে পারেনি।
স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশে হলগুলো কিন্তু প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সেগুলো ছিল এক একটি বন্দিশালা। গেস্টরুম কালচার, নাইট কালচার সবই ছিল সেখানে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালাত। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর কিন্তু সেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এসেছে।
১৫ তারিখের ঘটনাটার পরে আমরা শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে বক্তব্য দিচ্ছিলাম, শিক্ষার্থীদের কোটার পক্ষে যে দাবি তা সমর্থনে সোচ্চার ছিলাম। ক্লাসে কথা বলেছি, তাদের ছুটি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এভাবে আমরা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে গেছি, কারণ এটি যৌক্তিক আন্দোলন ছিল। যৌক্তিকতার বড় যে জিনিস ছিল, যারা মহান স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, তাদের সন্তানদের কোটা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু নাতিপুতির জন্য কোটা অন্যায়।
শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের দ্বারা পুরো ক্যাম্পাসে মারধরের শিকার হলো তখন আমি ক্লাসে ছিলাম। বের হয়ে ঘটনা জানতে পারলাম। সেখানে চার শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। আমি তাৎক্ষণিক আমার বিভাগের শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। এদিনের ঘটনাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং অনেক হল প্রশাসন যেভাবে ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তা শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা ১৫ তারিখ রাতেই ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে, শিক্ষার্থীরা আহত হওয়ার পর, আমরা শিক্ষকরা তাদের চিকিৎসা, অর্থ সহায়তার মাধ্যমে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ি।
পরদিন ১৬ তারিখে শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনারে অবস্থান নেয়। আর ছাত্রলীগ তাদের ক্যাডার বাহিনী ও টোকাইদের নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। তখনই বোঝা হয়ে গেছে এ আন্দোলন সফলতার দিকে যাচ্ছে। আমি কোনো দলের শিক্ষক না, তবে আমাদের মনে দোলা দিল যে আমার শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে এসে মারধর করবে, আমরা তো বসে থাকতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বিশেষত্ব হলো এদেশের সব আন্দোলনে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আমরা বলি এটা একটা স্যান্ডউইচ। যখনই তারা কোনো আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক হয়েছে তা সফল হয়েছে।
সফলতার হাতছানি দেখে মনোবল আরও দৃঢ় করে শিক্ষার্থীরা জুন থেকে আন্দোলনে থাকলেও ১৭ তারিখ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা এদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক হলো। ১৫ এবং ১৬ তারিখে আমরা শিক্ষকরা আলোচনা করছিলাম কী করতে পারি। দুটি থ্রেট আমাদের সামনে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য করলে চাকরিচ্যুতি ও হয়রানির আশঙ্কা ছিল। দ্বিতীয়ত এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল যেখানে সরকারবিরোধী কথা বললে গুম, খুন যা ইচ্ছে করতে পারত। তবে এসব মাথায় নিয়েও শিক্ষক কিংবা বাবা হিসেবে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আমি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ১৭ তারিখের মতো ভয়ানক পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। সেদিন আমি যখন ক্যাম্পাসে যাই তখন দেখি নীলক্ষেতের রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়া। ডানদিকে আগুন জ্বলছে, বামদিকে শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে। ১৬ তারিখে আবু সাঈদসহ যারা মারা গেছে তাদের গায়েবানা জানাজা ছিল ক্যাম্পাসে। সেদিন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার পরিচয় দেওয়ার পরও আইডি কার্ড দেখতে চায়। আমি বললাম, এমন নিয়ম নেই। তারপর বাধ্য করেই আইডি কার্ড দেখল।
১৭ তারিখে আমরা আলোচনা করে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক এক ব্যানারে একটা মানববন্ধন করতে সমবেত হই অপরাজেয় বাংলায়। সেখানে বিএনপিপন্থি শিক্ষক, বাম ও সাধারণ শিক্ষক ছিল। পরে আমরা সংবাদ পাই শাহবাগ থানায় নিরীহ দুজন শিক্ষার্থীকে আটক করে রাখা হয়েছে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই তাদের ছাড়িয়ে আনব। পরে আমরা শাহবাগ থানায় গিয়ে তাদের বুঝিয়ে ছাড়িয়ে আনি। আমরা তাদের ছাড়িয়ে এনে অপরাজেয় বাংলায় চলে আসি। সেখানে ততক্ষণে ঘোষণা হয়, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে হবে।
আরেক প্রেক্ষাপটে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে ডক্টর মামুন বলেন, যখন আমরা অপরাজেয় বাংলার সমাবেশ শেষ করলাম, আমি ব্যানারটি গুছাচ্ছি। তখন সেখানে তানজিম ভাই, গীতি আরা আপা, সামিনা লুৎফা ছিলেন। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের কাছে আসে। তারা বলছিল, আজ রাতেই হল ছেড়ে দিতে হবে। আপনারা উপাচার্যকে বলতে পারেন কি না হল যেন বন্ধ না করে। বন্ধ করলে আন্দোলনের মৃত্যু ঘটবে। আমরা তখন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিই, তখন অনেক শিক্ষকই চলে গেছেন। মাইক এবং ব্যানার সেখানে ফেলে রেখেই আমরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসার দিকে যাই। আমরা মাত্র ৫ থেকে ৭ জন শিক্ষক ছিলাম। কিন্তু বিজিবি-পুলিশ মিলে অন্তত দেড়শ জন মনে হয় আমাদের ঘেরাও করে রেখেছিল। আমরা তখন বললাম, ভিসির সাথে দেখা করতে চাই, তখন বলা হলো ভিসি বাসভবনে নেই। তবে আমরা জানতাম ভিসি আছেন, তাই কোনোভাবেই সেই গেট থেকে সরিনি আমরা।
একসময় আমরা ভাইস চ্যান্সেলর বাসভবনের গেটে ধাক্কানো শুরু করি। একপর্যায়ে গেট খুলে দেওয়া হলো। আমরা কয়েকজন শিক্ষক ভেতরে যাই। একটু যাওয়ার পর প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল টিম আমাদের আটকে দেয় এবং ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। তখন প্রক্টরের সঙ্গে হল বন্ধ নিয়ে কথা বলি। তখন উনাকে আমরা হল বন্ধের প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু সেদিন রাতেই হল বন্ধ করে দেয়া হয়। পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
ততক্ষণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলশানে তারা রাজপথে নেমে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দারুণ ভূমিকা রাখে। অনেকে বলার চেষ্টা করছে কোটাবিরোধী আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের আন্দোলন ছিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, কোটা আন্দোলন শুধু কোটা নিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সবাইকে মাঠে নামিয়ে আনে।
ঢাবির এই শিক্ষক বলেন, ১৮ তারিখে আমাদের শিক্ষার্থীদের যারা মূল সমন্বয়ক, তাদের আটক করে ডিবিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ তারিখে সাজানো একটি নাটক মঞ্চস্থ করে। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন তার ওপর আর আদালতের ওপর ভরসা রাখতে। এরপর ২১ তারিখে হাইকোর্ট রায় দিলেন, কোটা সাত শতাংশ থাকবে বাকিটা থাকবে না। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আছে, এমন রায়ের পরও কেন আন্দোলন থেমে যায়নি। যে বিনিময় মূল্যে, জীবনের মূল্যে কোটা কিনতে হলো, তখন কি কোটা আন্দোলন থাকা উচিত ছিল। আবার ততদিনে কিন্তু জনমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার জন্য। তারপর আন্দোলন জোরদার হয়।
এরপর একে একে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। ধারাবাহিকভাবে অসহযোগ আন্দোলন, ধর্মঘট, ব্লকেড চলতে থাকে। একই সঙ্গে সরকারের কারফিউ উঠানো নামানোর নাটক চলতে থাকে। আমরা দেখলাম, ৩০ তারিখের আগেই শতাধিক মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ১, ২, ৩ আগস্ট থেকে যেভাবে মারা হলো তা হাজার ছাড়িয়ে গেল।
এক আগস্ট থেকে যখন প্রেস ক্লাবে গণদ্রোহ দেওয়া হলো, তখন শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। আমি সাদা দলের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের কৃতজ্ঞতা জানাই তারা প্রতিটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকদের অংশগ্রহণ একেবারে নগণ্য ছিল। তখন থেকেই বুঝতে পারি সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে।
আগস্টের ১ তারিখে আমরা প্রেস ক্লাব থেকে যখন শহিদ মিনারে আসি তখন সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায়। এদিন হাইকোর্টে কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন করে, এখানে আমাদের একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়, তারও প্রতিবাদ করেছি আমরা। ২ আগস্ট কয়েকটি বিভাগ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। প্রতিটি আন্দোলনে যাই আমি। ২ আগস্ট প্রচুর বৃষ্টি ছিল, আমরা বৃষ্টিতে ভিজে মানববন্ধন করেছি। সেদিন প্রোগ্রামের জন্য ক্যাম্পাসে কোনোভাবেই মাইক আনতে পারছিলাম না। তখন আমরা গাড়ির পেছনে করে মাইক আনি। নীলক্ষেতে ব্যানারও প্রিন্ট করতে পারছিলাম না। সেখানে একটা দোকান আমাদের সহায়তা করেছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলো সংযুক্ত হয়েছে। আন্দোলনে যত দিন গড়িয়েছে বিএনপি, জামায়াত, বামদলগুলো সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে আমি মনে করি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উদ্যোগ না নিলে শেখ হাসিনার পতন হতো না।
৩ আগস্ট সকালে ক্যাম্পাসে আমরা একটি র্যালি করি, বিকেলে শহিদ মিনারে সমবেত হই। নাহিদ তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক দফা দাবি দেয়। সেদিন লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়। আমি যখন সন্ধ্যা ৭টার দিকে বের হয়ে আসি, তখনও দেখি মানুষ যাচ্ছে। তখন বোঝা যাচ্ছিল শেখ হাসিনার পতন সন্নিকটে। সেদিন একজন রিকশাওয়ালাও বলছিল শেখ হাসিনা ঘোড়ার ডিম, জাতির পিতা ইব্রাহিম।
এরপর চার আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের উদ্যোগে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় অপরাজেয় বাংলায়। অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক জোবায়দা, ড. মইশান, অধ্যাপক খুরশেদ আলম, অধ্যাপক ইসরাফিল শাহিন, ড. তিতাস এরকম কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে আমরা এই সমাবেশের আয়োজন করি। সেখানে আসিফ নজরুল স্যার থেকে শুরু করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকদের সবাই অংশগ্রহণ করে। আমার ধারণা, ৪ তারিখ সমাবেশটি সবচেয়ে বড় শিক্ষক সমাবেশ ছিল।
ওই সমাবেশ থেকে আমরা এক দফা দাবি উপস্থাপন করি। তিনি বলেন, সমাবেশ শেষে আমরা একটি র্যালি বের করি। এখানে দেড় থেকে দুইশ শিক্ষক জমায়েত হয়। র্যালিটি যখন রোকেয়া হলের সামনে আসে তখন দেখি অনেক সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়। টিএসসি যখন পার হচ্ছিলাম, আমার ধারণা তখন দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। তারপর যখন সামনে যাচ্ছিলাম তা বাড়ছিল। একসময় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তখন আমরা চিন্তা করলাম যদি শাহবাগ যাই এত লোক নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেডে ঝামেলা বেঁধে যেতে পারে। তখন মিছিল সামনে না নিয়ে মসজিদের কাছ থেকে মিছিল ঘুরিয়ে ফেলি। টিএসসিতে এসে আমরা মিছিল শেষ করি।
এসএম হলের এই প্রভোস্ট আরও বলেন, সেদিনটি এত গুরুত্বপূর্ণের কারণ ছিল প্রতিবাদ সমাবেশে প্রত্যেক শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য সরাসরি কথা বলে। এদিকে ৫ আগস্ট যে কারফিউ ভাঙব তা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কারণ আমরা শিক্ষকরা মাঠে না নামলে শিক্ষার্থীরা নামতে পারবে না। মারধর হামলার শিকার হবে। আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রাম করতে পারলেও সে সময়টায় শিক্ষার্থীরা প্রোগ্রাম করতে পুলিশের বাধা পেত। তাই পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের প্রতিটি প্রোগ্রামে তারা আসত।
৫ তারিখ সাড়ে ১১টায় আমি বাসা থেকে বের হই কারফিউ ভেঙে ক্যাম্পাসে যেতে, তখন পুলিশ বিধ্বস্ত। কিন্তু সে সময় আমিনুদ্দীন প্রাইমারি স্কুলের কাছে সরাসরি ফায়ার করে পুলিশ। তখন আমি বাসায় ঢুকে যাই। একটু পর আমার এক কলিগ ফোন করে বলে, ক্যাম্পাসে অনেকে আসছে তখন ক্যাম্পাসে যাই। সে সময়টাতে সাড়ে ১২টা বাজে। এর মধ্যে আমরা খবর পাই হাসিনা পদত্যাগ করবে। একজন কলিগ জানায় হাসিনা চলে গেছে। কিন্তু পুলিশ তা জানত না, তারা তখনও মারমুখী। তারপর সেনাপ্রধান ভাষণ দিলেন শেখ হাসিনার পদত্যাগের। তৈরি হয়েছে নতুন এক ইতিহাস। আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই জুলাইয়ের শহিদদের। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে পেরেছি।
সহযোগী অধ্যাপক, জাপানিজ স্টাডিজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সময়ের আলো/আরএস/