বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক অন্যায়। আমাদের দেশে অধিকাংশ বিয়ে সম্পন্ন হয় মেয়েদের বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের বয়স ২১ বছর হওয়ার আগে। বয়সের হিসেবে যাদের কিশোর বলা যায়। আমরা সামাজিকতার কথা বলে তাদের প্রতি বাল্যবিয়ে নামক অন্যায় আচরণ চাপিয়ে দিচ্ছি। অথচ বাল্যবিয়ে নিরোধ করার জন্য ইতিমধ্যে আইন প্রণীত হয়েছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সঠিকভাবে পালন করা হয় না।
তবে আশার কথা যে আমাদের দেশে ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭’ প্রচলিত আছে। এ আইনে ২২টি ধারা আছে। তার মধ্যে অষ্টম ধারায় আছে, ‘পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্যবিয়ে সম্পন্ন করিবার ক্ষেত্রে কোনো কাজ করিলে অথবা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বছর ও অন্যূন ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেক এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেক’।
তা ছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান বা বয়স নির্বিশেষে প্রতিটি কন্যাশিশুর নিরাপদ, শিক্ষিত এবং সুস্থ জীবনের অধিকার বিদ্যমান। এই অধিকারগুলো যথেষ্ট যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। এগুলো নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কাজ চলছে। এর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত রয়েছে কন্যাশিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন, উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের দেশ এবং কন্যাশিশুরা এর আওতায় আছে। তবু কখনো কখনো না চাইতেই বাল্যবিয়ের মতো অনাকাংখিত ঘটে।
তবে এমন সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে হবে আমাদের কন্যাশিশুদের। এ জন্য প্রথমেই এর কারণগুলো খুঁজে বের করতে হয় এবং পরে সুষ্ঠু সমাধানের উপায় অনুসন্ধান করা যায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বাল্যবিয়ের কারণ হলো অর্থনৈতিক সংকট। বাল্যবিয়েকে প্রায়ই আর্থিক বোঝা কমানোর এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নত করার উপায় হিসেবে দেখা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং লিঙ্গ বৈষম্য, যা সবসময়ই কন্যাসন্তান এবং নারীদের অবমূল্যায়নের পথে নিয়ে যায়।
শিক্ষার অভাব এবং বাল্যবিয়ের নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব বাল্যবিয়ের প্রসারে বিশেষ অনাকাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখে। কখনো পারিবারিক সংঘাত ও প্রাকৃতিক কারণে বাস্তুচ্যুতি হলে মেয়েদের নিরাপত্তা এবং অস্থিরতা থেকেও রক্ষার করার জন্য মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন প্রচলিত আছে তবু আমাদের দেশের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে ধারণাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হয়।
গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ওপর বাল্যবিয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। তাই আনন্দের সঙ্গে কন্যাসন্তানের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়। মনে করা হয় পিতামাতার একমাত্র দায়িত্বই হলো সুপাত্রে কন্যাদান করা। কখনো কখনো পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য বাল্যবিয়ের মতো জটিল কর্মটি সম্পাদন করা হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে আর তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশ সম্পন্ন হয় না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় ফলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও থাকে না, একই সঙ্গে হারায় পরিবারে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাও। এটি সমাজ বিকাশে দারিদ্র্য ও লিঙ্গ বৈষম্যের চক্রকে স্থায়ী করে দেয়। মেয়েরা আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। এ ধারা চলতে থাকে বংশ পরম্পরায়।
কন্যাসন্তানের জীবনে বাল্যবিয়ের কুফল হলো বিপজ্জনক গর্ভধারণ, গর্ভপাত, মাতৃমৃত্যু এবং স্থায়ী অসুস্থতা। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক জননীও একটি অন্যতম কারণ। বাল্যবিয়ের ফলে বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হারও অনেক বেশি। তা ছাড়াও কন্যাশিশুটি স্বামীর কাছে শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হতে পারে। বাল্যবিয়ে নানা ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা জরুরি এবং এর জন্য দরকার একটি ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সবার আগে দরকার বাল্যবিয়ের নেতিবাচক দিকটি সম্পর্কে সমাজ ও পরিবারকে সচেতন করা। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সমাজের মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে। মেয়েদের বিবাহ বিলম্বিত করা এবং তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগের মতো বিকল্প অভ্যাসগুলোকে প্রচার করা অব্যাহত রাখা হচ্ছে। বাল্যবিয়েকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনা বাস্তবায়ন করাও হয়েছে। বিদ্যালয়গামী মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে এবং মেয়েদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্তুত করার জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
বাল্যবিয়ে সম্পর্কে পারিবারিক মনোভাব এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আরও অধিক প্রচারণা দরকার। এই প্রচারাভিযানে ধর্মীয় নেতা, সম্প্রদায়ের প্রবীণ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী অংশীজনের অন্তর্ভুক্তি থাকা উচিত। এসব ব্যক্তি মেয়েদের শিক্ষার মূল্য এবং বাল্যবিয়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কে প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে পুরুষরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্পর্কিত শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারাভিযানে তাদের নিযুক্ত করা যায়। অল্প বয়সে বিয়ে সম্পর্কিত মনোভাব এবং সামাজিক নিয়ম পরিবর্তন করতে এবং লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে উন্নীত করতে তারা ব্যাপক মাত্রায় সাহায্য করতে পারে।
বাল্যবিয়ে প্রতিহত করার জন্য আমাদের সবার সচেতনতা দরকার। দরকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, এটি সবাইকে জানানো দরকার। জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোনো বিয়ে যেন রেজিস্ট্রি করা না হয় সে বিষয়ে বিবাহ রেজিস্টারকে সচেতন করতে হবে।
স্কুল-কলেজের মেয়েদের বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে এবং এটি রোধ করার উপায়টিও তাদের জানিয়ে দিতে হবে। তা হলে একসময় তারা নিজেরাই বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। তবে এটি বলাই বাহুল্য, আজকাল স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সহপাঠীকে বাল্যকালে বিয়ে দেওয়া প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেয়েদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিতে হবে।
তা ছাড়া মেয়েদের বিয়ের নির্ধারিত বয়সসীমা অনুসরণ করা এবং এ আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে কাউন্সেলিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনি সহায়তার মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা যায়।
সময়ের আলো/আরএস/