তাম্বুল বা পান চিবানোর মানুষ দেশে গুনে শেষ করা যাবে না। গল্প করতে গেলে পান লাগে। সালিশ-বৈঠক করতে পান লাগে। এমনকি আপ্যায়ন-মেজবানিতেও পানের বিকল্প নেই। আর পান না হলে তো বিয়ে বাড়ির আয়োজন জমেই না। তাই পানের গল্প বলে শেষ করা যাবে না। এদেশে নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানে পানের সংস্কৃতি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই পানের প্রধান অনুষঙ্গ সুপারি।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর উপজেলায় এবার সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। সুপারির মোকামগুলোয় খুচরা পাইকারি কেনাবেচায় ব্যস্ত চাষি ও পাইকাররা। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি উৎপাদনে উপযোগী। এ জনপদের এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়িতে সুপারি গাছ নেই। এ ছাড়া বিশাল-বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে সুপারির বাগান। এ বাগান করে উৎপাদন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সুপারি। বাজার দর ভালো থাকায় সুপারি চাষে আগ্রহ বাড়ছে এখানকার মানুষের। তবে নদী ভাঙার কারণে দিন দিন সুপারি চাষ কমে যাচ্ছে। মানুষের ঘরবাড়ি ভিটেমাটি নদীর কবলে পড়ে বিলীন হওয়ায় চাষ করার মতো তেমন জায়গা এখন আর নেই। নদীভাঙনের ফলে দিন দিন কমছে সুপারি চাষ। তারপরও এই লাকায় সারি সারি সুপারি বাগান ভরে উঠছে ফলনে।
রামগতি ও কমলনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। সুপারি বাগান করার মধ্য দিয়ে এখানকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যার কারণে এবার এ উপজেলায় সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার কাঁচা-পাকা সুপারির দাম কিছুটা বেশি। এতে ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষিরা। কমলনগর উপজেলায় এবার ১১৯ হেক্টর জমিতে সুপারি আবাদ হয়েছে।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯৫ টন। যার বাজার মূল্য ১৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর রামগতি উপজেলায় ৬৫৯ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ করা হয়েছে। এখানে প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি টাকার সুপারি উৎপাদন হবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সুপারি গাছে ফুল আসে। এ ফুল থেকে সৃষ্ট সুপারি পুরোপুরি পাকে কার্তিক-অগ্রহায়ণে। মূলত কার্তিক মাস আর অগ্রহায়ণ মাসেই সুপারির ভরা মৌসুম। তবে এবার সময়ের আগেই বাজারে এসেছে সুপারি। এবার আশি^ন মাসের শেষের দিকে বাজারে আসতে শুরু করে সুপারি।
এখন উপজেলার প্রতিটি বাজারেই প্রচুর সুপারি আসছে। এখানকার সুপারির প্রায় ৭০ শতাংশ নদীনালা, খালডোবা, পুকুর ও পানিভর্তি চৌবাচ্চায় ভিজিয়ে রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর ৩০ শতাংশ সুপারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ ছাড়াও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এ বছর কাঁচা-পাকা সুপারির ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষি, গৃহস্থ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় সুপারি প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র না থাকায় অনেক সময় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না বলে অভিযোগ।
এ বছর মৌসুমের শুরুতেই সুপারি বিক্রির মোকাম রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার, রামদয়াল বাজার, বিবিরহাট, রামগতি বাজার, আযাদনগর, হাজিগঞ্জ, বান্দেরহাট, জমিদারহাট, চরসেকান্তর ও আশ্রম এবং কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, করুনানগর, তোরাবগঞ্জ ও ফজুমিয়ারহাটসহ উপজেলার প্রতিটি বাজারে সুপারি ঘিরে চলছে জমজমাট কেনাবেচা।
স্থানীয় কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা নিজেদের চাহিদা মতো সুপারি স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন। এ বছর প্রতি পোন সুপারি (৮০টি) মানভেদে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, প্রতি কাউন (১২৮০টি) ২৭শ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে এবার বাজারে সুপারির দাম অন্যন্য বছরের তুলনায় বেশি।
রামগতি উপজেলার জমিদারহাট এলাকার সুপারি চাষি হুমায়ুন কবির, রাসেল শেখ বলেন, সুপারি উৎপাদনে খরচ কম। একবার গাছ লাগালেই হলো। গাছের তেমন পরিচর্যা করতে হয় না। অন্য ফসলের চেয়ে অধিক লাভ। চাহিদা বেশি থাকায় প্রত্যাশিত দামও পাওয়া যায়।
কমলনগর উপজেলার করুণানগর এলাকার সুপারি চাষি আবুল খায়ের ও আলী আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে চারা লাগালে ও যত্ন নিলে ৬ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সুপারির ফলন আসতে শুরু করে। তবে বেশি ফলন ধরে ১০ থেকে ১২ বছরের পর।
রামগতি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ তারেক বলেন, সুপারি বাগানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কিংবা রোগবালাই কম থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এখানকার উৎপাদিত সুপারি জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহীন রানা বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ অঞ্চলে সুপারি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অন্যান্য ফসলের তুলনায় অধিক লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
সময়ের আলো/আরএস/