
অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আগে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র না আগে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে শক্তিশালী গণতন্ত্র ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন একে অন্যের পরিপূরক এতে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচনব্যবস্থায় নানা ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় বলেই শক্তিশালী গণতন্ত্র পাই না।
আবার শক্তিশালী গণতন্ত্র পাই না বলেই আমরা একটি ভালো নির্বাচন করতে পারি না। তাই নির্বাচনের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে শক্তিশালী গণতন্ত্র বিনির্মাণে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের খোঁজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্তী সরকারের জন্য বর্তমানে এটিই সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়।
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর কয়েক দিন ধরেই সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। দেশের সব জাতীয় পত্রিকা খুব গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করছে। হিসাব-নিকাশ হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার কী কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়েও। অনেকের ভাবনা ট্রাম্পের জয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
কিন্তু এটি সবারই জানা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান যেই হন না কেন পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না, তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতি আশাবাদী অথবা নেতিবাচক চিন্তা করে বোধহয় তেমন লাভ হবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি হাওয়াটা পালে লাগাতে রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে বড় দল হিসেবে বিএনপির চেষ্টার অন্ত নেই। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারেরও সেদিকেই নজর। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পূর্ণ হলো। অন্তর্বর্তী সরকার সত্যিকার অর্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথেই এগোচ্ছে তা বলা যায়।
এ কথা সত্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের আগামীর নির্বাচন কেমন হতে পারে কিংবা কবে নাগাদ হতে পারে তার আলোচনাটা একটু জোরেশোরে হচ্ছে। জনগণের ভাবনাটা রাজনীতিবিদরা বোঝার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে জনগণকে নির্বাচনমুখী করার চেষ্টা করছে। এটি নিশ্চয় রাজনীতিবিদদের ভালো দিক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার না করেই কি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার? বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা বলছেন। তারা হয়তো বলতে চাচ্ছে নির্বাচিত সরকারই সব সংস্কার করুক। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সব পেশার এত লোকের আত্মত্যাগ শুধুই কি নির্বাচনের জন্য? নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কীভাবে হতে পারে? এতটুকু সময় তো রাজনীতিবিদদের ধৈর্য ধরতে হবে।
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে মতামত চেয়ে বিগত ২২ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সার্চ কমিটি আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে দশজনের নাম প্রস্তাব করবেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
এটি অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের প্রথম ধাপ বলা যায়। আগামী ১৫ নভেম্বর আগ্রহী ব্যক্তিদের সংস্কার কাজের জন্য পরামর্শ, মতামত ও প্রস্তাবনা পাঠানোর সময় শেষ হচ্ছে। নব্বই দিনের মধ্যে সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ পর্যন্ত লিখিত, ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, ফেসবুক মেসেঞ্জারে ৫০০-এর বেশি সুপারিশ পেয়েছে কমিশন। এদিকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। তবে আগামী বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন হতে পারে বলে একটা অভিমত দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নতুন নির্বাচন কমিশনে গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি, সংবিধান ও নির্বাচনি আইন, প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, ভোটের স্বচ্ছতা এবং নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা।
এদিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যতটুকু সময় দরকার রাজনীতিবিদরা ততটুকু সময়ই দিতে চান। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সংস্কারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলেও রাজনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করছেন। তাই নির্বাচন আয়োজনে বেশি সময় নিলে জটিলতা দেখছেন অনেকেই। ন্যূনতম সংস্কার কার্যক্রম করেই অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন বেশিরভাগ রাজনীতিবিদরা। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের পথে হাঁটতে চান না। কেননা আর কোনো ফ্যাসিস্টের যাতে জন্ম না হতে পারে তার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য বলা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ছাড়াও পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করেছে। এসব সংস্কার কমিশনের ওপরই নির্ভর করছে আগামীতে নির্বাচন কেমন হতে যাচ্ছে। এসব সংস্কার নির্বাচনের পূর্বেই শেষ হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। তাই সংবিধান সংশোধনের পরই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আশা করা যেতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পলায়নের পর ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ করেন। এভাবে নির্বাচন কমিশনের পুরো সদস্য একযোগে পদত্যাগের নজির প্রথম। এই কমিশনের মাধ্যমেই একটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অভিযোগ আছে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগকে একটি ডামি নির্বাচনে সার্বিক সহযোগিতা করে ক্ষমতায় বসায় এই কমিশন। তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও কতটুকু দায় এড়াতে পারবেন তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। এ ধরনের অকার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা বদলাতেই নির্বাচনব্যবস্থার যথাযথ সংস্কারে মনোযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অডিও ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফোনালাপে শেখ হাসিনা একজন দলীয় কর্মীকে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি ব্যবহার করে শহিদ নূর দিবসে মিছিল করার পরামর্শ দিতে শোনা যায়। মিছিলে কোনো হামলা হলে সেটি ট্রাম্পের ছবিতে হবে।
সেই ছবি পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে তুলে তাকে পাঠানোর জন্যও বলা হয়। এ ছাড়া আরও ভয়ংকর কিছু কথাবার্তা প্রাধান্য পায় ফোনালাপে। প্রতিশোধ ও দেখে নেওয়ার হুমকির কথাও শোনা যায়। কিন্তু কেন এই ঘৃণ্য খেলায় কর্মীদের অংশগ্রহণের নির্দেশনা দিলেন শেখ হাসিনা? এ ধরনের উসকানি জনমনে অস্বস্তি তৈরি করে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের মনে রাখতে হবে এভাবে দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে, দেশের ক্ষতি করে রাজনীতিতে ফিরে আসা যায় না।
আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১০ নভেম্বর শহিদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ খবরে উত্তাল ফেসবুক ও রাজধানীসহ সারা দেশ। হঠাৎ আওয়ামী লীগের এমন প্রত্যাবর্তন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা মেনে নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে ঘিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা সকাল থেকেই দখলে নেয় রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট। দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার প্রত্যয়ে একই স্থানে পাল্টা গণজমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে বিদেশে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণে ষড়যন্ত্র থেমে নেই তা সুস্পষ্ট। এমন আচরণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে। তারেক রহমান তীব্র প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, একজন উপদেষ্টার সঙ্গে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ শুধু অনভিপ্রেতই নয় বরং দেশ ও জনগণের আত্মমর্যাদার ওপর প্রচণ্ড আঘাত। তিনি আরও বলেন, পতিত শেখ হাসিনা দেশের রাজনীতিকে জটিল করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লুটপাটে সুবিধাভোগীরা বিদেশে গভীর চক্রান্তে মেতে উঠেছে। তিনি আত্মপ্রত্যয়হীন, যুক্তিবিমুখ, মানবতাবিরোধী আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ও তাদের দোসরদের চিহ্নিত করতে এবং শাস্তির আওতায় আনারও দাবি করেন।
এভাবে ইউনূস সরকারকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে অনেকটা প্রকাশ্যেই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় রয়েছে। ইউনূস সরকারকে অবৈধ এবং ফ্যাসিস্ট তকমা দেওয়ার জন্যও চক্রান্ত চলছে। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে ইউনূস সরকারকে খুব সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।
সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই অন্তর্বর্তী সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফেরত আনবেন এই প্রত্যাশা সবার। আর যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে সেই নিশ্চয়তার জন্য সরকারকে এমন একটি সংস্কার অবশ্যই করে যেতে হবে যাতে ভবিষ্যতে জনগণকে আর কখনোই রক্তপাতের মাধ্যমে আরেকটি স্বৈরশাসনের মোকাবিলা না করতে হয়।
আওয়ামী লীগ এ দেশের নির্বাচনিব্যবস্থা ধ্বংস করে গেছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই সেখান থেকে ফিরতে হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির উপস্থাপন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নিহিত রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল তখনই জনগণ ঘরে তুলতে পারবে। একটি সুন্দর, আগামী এবং সত্যিকারের দেশ গড়ায় অগ্রণী ভূমিকায় জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রতিষ্ঠিত হবে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র। ভবিষ্যতে আর জন্ম নেবে না কোনো দানব সরকার এটিই জনগণের ভাবনা, জনগণের প্রত্যাশা।
গবেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
সময়ের আলো/আরএস/