মধ্যযুগে বাংলার মুসলমানরা যেসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তার মধ্যে লিপিকলা অন্যতম। মধ্যযুগ বাংলার মুসলমানদের জন্য একটা সোনালি যুগ। অনুবাদ, শিল্প, সাহিত্য থেকে সর্বত্র তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতার নান্দনিক পরিচয় রাখেন। মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি, মুদ্রা ও শিলালিপিতে আরবি-ফারসি ভাষা প্রাধান্য লাভ করে। এ প্রসঙ্গে মধ্যযুগে মুদ্রা ও শিলালিপিতে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি নামক গ্রন্থে শাহনেওয়াজ এ. কে বলেন, মধ্যযুগে বিশেষত সুলতানি বাংলায় মুদ্রা ও শিলালিপিগুলো অধিকাংশই আরবি ও ফারসি ভাষায় উৎকীর্ণ ছিল। লিপিগুলো খোদিত হয়েছে হস্তলিপি শিল্পের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।
মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলা : মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলার বেশ বৈচিত্র্যময় রূপশৈলীর চিত্র প্রত্যক্ষ হয়। যেগুলোতে পাওয়া যায় নন্দনতত্ত্বের সব নান্দনিক ছোঁয়া। তার মধ্যে অন্যতম কিছু হলো-নাসখ, কুফিক, রিকা, ছুলুছ, তাওকি, তালিক, মুহাক্কাক, নাস্তালিক, রায়হানি, দিওয়ানি, তুঘরা, সিকস্তা, গুরাব, গুলজার, তাওস, মাহি ও আফতআবি প্রভৃতি।
মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলার প্রয়োগ : মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলার প্রয়োগ হতো মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রে, মসজিদ, মক্তব, অট্টালিকা ও ধাতব মুদ্রা তৈরিতে। এ ছাড়া পাণ্ডুলিপিতেও এর অসাধারণ সৌন্দর্যের ছোঁয়া দেখা যেত। বিশিষ্ট গবেষক হাফিজ মাহবুবুর রহমান রচিত গবেষণাকর্ম মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম লিপিকলা : সূচনা ও বিকাশ গ্রন্থে লিপিকলার প্রয়োগের অনুরূপ উপাদানগুলো পাওয়া যায়। যেমন-টাঁকশাল, মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি, শিলালিপি প্রভৃতি। সুলতানরা মুদ্রাকে জনগণের সহজলভ্য করার জন্য টাকশালের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শিল্পকলার বিকাশে প্রায় সাতাশটি টাকশালের গুরুত্বও অতুলনীয়।
মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলার বিকাশ : মধ্যযুগের মুসলিম লিপিকলার বিকাশ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, মুসলিম লিপিকারকরা সত্তরটিরও অধিক লিপিশৈলীর উদ্ভাবন করেন। যদিও এ কথাটি নিয়ে মতানৈক্য বিদ্যমান। কেননা মুহাক্কাক, রিকা, তাওকি, কুফিক, নাসখ, ছুলুছ, তুঘরা, নাস্তালিক, রায়হানি
প্রভৃতি লিপিশৈলী মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিকশিত ছিল। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম লিপিশিল্পীরা কালের ইতিহাসে লিপিকলার অনবদ্য স্বাক্ষর রাখেন। এ প্রসঙ্গে লিপিকলা গবেষক ইয়াকুব আলী তার মুসলিম মুদ্রা ও হস্তলিখন শিল্প গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, লিপিশিল্পীরা তাদের সুকুমার বৃত্তির স্বাক্ষর রেখেছেন স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ও পিতলের নির্মিত আহার পাত্রে। এ ছাড়া প্রদীপ, ফুলদানি, দোয়াত, ঝুড়ি, যুদ্ধের হেলমেট, অস্ত্র ইত্যাদি অবয়বের অলংকরণে হস্তলিখন শিল্পকে ব্যবহার করেছেন যা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ মধ্যযুগে লিপিশিল্পের বিকাশ বিশ্ব দরবারেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শিল্পকলার প্রধান চর্চা হতো মুদ্রা, মাদরাসা, মসজিদ, খানকা, দরবার, ঈদগাহ, ফটক, সেতু নির্মাণের কাজে। বিশেষ করে মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম শিল্পকলার বিকাশে মুদ্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনিময় যোগ্য মুদ্রা বিশ্বদরবারে শিল্পকলার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
মধ্যযুগে মুসলিম লিপিশিল্পীদের মর্যাদা : মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শাসনকালে লিপিশিল্পীদের মর্যাদা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের অনবদ্য শিল্পকর্মের জন্য নানাবিধ উপাধি ও সম্মানী দেওয়া হতো। এমনকি রাজ দরবারেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। তারা রাজানুগ্রহ পেয়ে শিল্পচর্চায় আরও গভীর মনোনিবেশ করতেন। তাদের এ মর্যাদার বিষয়ে লিপিশিল্প গবেষক ইয়াকুব আলী বলেন, হুসাইন কাশ্মিরি জররি কলম, আবদুর রহীম আম্বারিন কলম, মীর খলিলুল্লাহ শাহ বাদশাহ কলম ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হন। লিপিশিল্পীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করার ফলে লিখনশিল্পকে বিভিন্ন রূপে ও বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপ দান করে সুষমামণ্ডিত করে তুলেছেন। মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম সম্রাট, সুলতান, তথা রাজা ও উচ্চবিত্ত মানুষজনও শিল্পীর শিল্পের মর্যাদা সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। ফলে শিল্পকলার বিকাশের অনিবার্য অগ্রগতি ঘটে।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সময়ের আলো/আরএস/