বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও প্রাণ ফিরে পাচ্ছেনা বরিশাল শহরের মাঝে বয়ে যাওয়া ২৩টি ছোট-বড় খাল। খননের অভাব ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নাব্য সংকটের পাশাপাশি প্রশস্ততা কমে মরে যাচ্ছে খালগুলো। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলেই নগরীজুড়ে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। আর এতে করে ভোগান্তি পোহাচ্ছে নগরবাসী। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, মন্ত্রণালয়ে ৩০টি খাল খনন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য প্রকল্প দেয়া হয়েছে। প্রকল্প পেলেই খালগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হবে।
এক সময় বরিশালের এই খালগুলো দিয়ে নৌকা, পাংশি নৌকা ও ছোট ছোট লঞ্চ চলাচল করতো। ৯০ দশকের আগে বরিশালে ৪৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে ২৩টি খাল রয়েছে তাও প্রায় মৃত।
খালের পাশের বসতবাড়ি ও দোকানপাট, বাজার থেকে প্রতিনিয়ত ময়লা আবর্জনা খালের মধ্যে ফেলার কারণে খালগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিভিন্নসময় খাল খনন ও পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছেনা বলে দাবি নগরবাসীর। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন থেকে খালগুলো পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু করলেও কয়েকদিন পর তা আবার পুরনোরুপে ফিরে আসছে। তাই খালের বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
বরিশাল নগরীর জেলখাল এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, বারবার পরিষ্কার করতে আসে। দু-একদিন পর আবার যেই তা সেই। টেন্ডার হয় শুনি কিন্তু বাস্তবে কিছু দেখি না। খালের কারণে মশার উপদ্রব আরো বাড়ছে। আমরা নানা সমস্যায় ভুগছি।
আলমগীর সিদার নামের আরো একজন জানান, খালগুলোর গভীরতা কমপক্ষে ১০ ফুট না করলে কাজ হবেনা। আমরা যারা খালের পাড়ে বসবাস করি তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ময়লা ও দুর্গন্ধে আমরা অতিষ্ঠ। খাল দখল হয়ে যাচ্ছে, যে যার মত খালে ময়লা ফেলছে। আমরা চাই খালটি সংস্কার হোক আমাদের এই সরকার কাছে দাবি যেন পুনঃসংস্কার করার ব্যবস্থা করেন।
বরিশালের সুশীল সমাজ বলছে, দীর্ঘ বছর ধরে বরিশালের খাল নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্প আসলেও তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছেনা। খালের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে খাল খনন জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) বরিশাল জেলা শাখার সম্পাদক রঞ্জিত দত্ত বলেন, খালের বিষয়টি বরিশাল বাসীর দীর্ঘ দিনের একটি আন্দোলন এবং খালগুলো যদি সংস্কার না হয় বরিশালের যে জলাবদ্ধতা ও জনগণের যে ভোগান্তি এগুলো কমবে না। খালের জন্য দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে বাজেটও আসছে সে বাজেট আসলেও কাজে বা বাস্তবে রূপ দান করেনি।
আমরা মনে করি খালকে খনন করা দরকার। খনন করে তার যে গভীরতা থাকার দরকার
সেটা ফিরিয়ে আনা দরকার। জোয়ার ভাটা রেগুলার ঢুকতে আর বের হতে না পারে তাহলে খাল সতেজ থাকবেনা। এই বাস্তবতা বরিশালে চলতেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নগরীর পোর্ট রোড থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত বয়ে চলা জেল খালটি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার ও পরিচ্ছন্নতা করার কাজ শুরু করা হয়।
ওই সময় শুধু জেল খালই নয়, শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সাগরদী, চাঁদমারী, নাপিত খালী, লাকুটিয়া, নবগ্রাম, ভাটার, আমানতগঞ্জ, টিয়াখালী, কাশিপুর, কলাডেমা ও শোভারানী খালসহ ২২টি খালের অস্তিত্ব উদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। আবারও এসব খাল ফের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়।
সবশেষ ২০১৯ সালের শেষ দিকে এসে সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামে সিটি করপোরেশন। এসব খালে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। খাল খননের বিষয়ে সিটি কপোরেশনের পক্ষ থেকে এর আগেও মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পাঠালোও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এবিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের আহ্বায়ক শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, এক সময় বরিশাল শহরের ভেতর দিয়ে ২২টি খাল প্রবাহিত হত। এখন ৬টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাকী খালগুলো দখলে দূষণে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন যাবত দাবি জানিয়ে আসছি এই বিদ্যমান খালগুলোর সংস্কার করতে হবে। সেই বিদ্যমান খালগুলোর প্রাণপ্রবাহ আমাদের সামনে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঘটা করে খাল পরিষ্কার করা হয়েছে কিন্তু খাল কাটার গত দেড়জুগেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর একটি স্থায়ী সমাধানে যাওয়া উচিত বলে মনে করি।
বরিশাল সিটি কপোরেশন বলছে, বিসিসির মোট ৪৬টি খালের মধ্যে ২০টি খালে খনন ও ১০টি খাল খনন, পাড় বাঁধাই, ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কাজ করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে ৯২৭ কোটি টাকার প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে। তবে এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ১০টি ও পর্যায়ক্রমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান থাকা আরো ৭টি খাল নিয়ে কাজ করা হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুমুল হাকিম রেজা জানান, আমাদের খালগুলো দীর্ঘদিনের অত্যন্ত অবহেলায় ও অবৈধ দখলের কারণে খুবই সংকীর্ণ ও মৃতপ্রায় অবস্থায় আছে। আমরা বরিশাল সিটি কপোরেশনে ৪৬টি খালের ভেতরে প্রথম পর্যায়ে ৩০টি খালকে কনসিডারেসনে নিয়ে এসে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছি। যে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে বর্তমানে আছে। আশাকরি সেটি যদি একনেকে অনুমোদন হয় তাহলে আমরা এই ৩০টি খালকে তাদের পুনরো রূপে ফিরিয়ে দিতে পারবো। ৩০টি খালের ভেতরে আমরা প্রথম পর্যায় ১০টি খালকে খননসহ দুই পাড় বাধাই করণ, বাইসাইকেল লেন, সবুজায়ন ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায় বাকি খালগুলোসহ আরো একটি প্রকল্পের চিন্তাধারা রয়েছে।
বরিশাল নগরবাসীর দাবি উপর থেকে পরিষ্কার নয় বরং খাল খনন করতে স্থানীয় কর্মকর্তা ও সরকারের ঊর্ধ্বতনদের পদক্ষেপ নিতে হবে। খাল খননের বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সময়ের আলো/জিকে