যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। এ কথাটি যেন কাকলী আক্তারের জন্য অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতেই বিয়ে; এরপর সংসার আর সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার অবকাশ মেলেনি তার।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা মেয়েটি কেবল সংসার আর সন্তান সামলাবেন এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিল না কাকলীর পরিবার। আর পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থনেই অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোয়ারি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজ কাজের জন্য মহিলাবিষয়ক অধিদফতর থেকে হবিগঞ্জ জেলা ও মাধবপুর উপজেলা পর্যায়ে পেয়েছেন ‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী’ জয়িতার সম্মাননা।
কাকলী হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বাঘমারা গ্রামের মো. আবদুল হামিদ খানের মেয়ে। মাধবপুর উপজেলায় বিয়ে হয় ২০১৬ সালে। ৩ ছেলে নিয়ে তার সংসার। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার শেষ করলেও দিনশেষে নিজের একটা পরিচয়ের অভাববোধ করতেন তিনি। সেই ইচ্ছাশক্তিতে ভর করেই প্রযুক্তির ব্যবহারে স্বল্প পুঁজি নিয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে স্থানীয় এলাকার পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। শুরুতে তাকে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়, তবুও দমে যাননি তিনি। নিজের লক্ষ্যের দিকে একমনে ছুটে চলেন। অবশেষে দেখা পেয়েছেন সেই কাক্সিক্ষত সাফল্যেরও।
২০২০ সালে কাকলী ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সোয়ারি’ শুরু করেন। তার পেজের মাধ্যমে মনিপুরী পণ্য, স্থানীয় চাল, ঢেকিছাঁটা আতপ চালের গুঁড়া, পাহাড়ি তেঁতুল, মৌসুমি আম, খেজুরের গুড়, শীতল পাটি, প্রাকৃতিক চাকের মধুসহ নানা পণ্য বিক্রি করেন। ধীরে ধীরে এ ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে কাকলীর ঘরে তৈরি আচার, নকশী কাঁথা, শীতলপাটিসহ বিভিন্ন পণ্য এখন দেশে বিদেশি সরবরাহ করা হয়। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন আরও ১০ জন নারী।
শুরুতে খুব একটা কাটতি না থাকলেও মানসম্মত পণ্য সরবরাহের কারণে কাকলী এখন স্থানীয় সবার মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কাকলীর ক্রেতারা ছড়িয়ে আছেন লন্ডন, আমেরিকা, সৌদি আরব, গ্রিস ও দুবাইয়েও।
এসব দেশে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করেন তিনি। পরিচিতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় নারীদের রোল মডেল হয়ে উঠেছেন তিনি। এখন পরিচিত অনেকেই ব্যবসা বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসেন কাকলীর কাছে। প্রতি মাসে কর্মীদের সবার বেতন ও ব্যবসার সব খরচ পরিশোধের পর তার হাতে থাকে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শ্রম, মেধা, ধৈর্য আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কাকলী আজ প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা।
জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রুমানা আক্তার জানান, কাকলী আক্তার শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণ করেননি, তিনি সমাজের আর দশজন নারীর স্বপ্নের কারিগর। তার এই পথচলা দেখে ই-কমার্স ব্যবসার প্রতি গ্রামগঞ্জে নারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাকে এখন আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে মোটিভিশনাল বক্তব্যের জন্য নিয়ে আসি। যাতে পিছিয়ে পড়া নারীরা তার মতো করে আরও এগিয়ে আসেন।
কাকলী আক্তার জানান, পড়াশোনা শেষ হতেই সংসার ও সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নিজের আলাদা পরিচয়ের অভাব আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। চার বছর আগে শূন্য হাতে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন এলাকার বহু লোক আমাকে চেনে। দেশে ও দেশের বাইরে থেকে ক্রেতারা ফোন করে খোঁজ নেন।
কাজ না করলে এত মানুষের ভালোবাসা পেতাম না। আমাকে সহায়তা করছেন দশজন নারী। তাদের পরিবারও উপকৃত হচ্ছে। নারী এগিয়ে গেলে দেশ
এগিয়ে যায়।
সময়ের আলো/জিকে