বছরদশেক আগেও নারীদের মোটরসাইকেল চালাতে দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত মানুষ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে নারীর অগ্রযাত্রা। দেশের নানা প্রান্তে এ চিত্র এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল দোহার ও নবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নারীরা মোটরসাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সবখানে। ঘর, গৃহস্থালি, নিত্যপণ্যের বাজারে যাতায়াতসহ পরিবারের চাহিদা মেটাতে নারীদের মোটরসাইকেলের ব্যবহার দেখা মেলে অহরহ।
দোহারের নারী মোটরসাইকেল চালক ও অভিভাবকদের কাছে এক নামে পরিচিত রিক্তা আক্তার মোনা। কেননা ইতিমধ্যে দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার শতাধিক নারীকে মোটরসাইকেল চালনা শিখিয়েছেন এ নারী। এলাকার সবাই তাকে মোটরসাইকেল প্রশিক্ষক রিক্তা নামেই ডাকেন। উপজেলা সদরে মোটরসাইকেলে ঘোরাফেরায় তাকে সবাই দেখেন। নানাজনের বিরূপ মন্তব্য করলেও তাতে থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।
বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান রিক্তা। রিক্তা দুই বোনের মধ্যে বড়। ছোট্ট সময় থেকেই খুব দুরন্তপনায় মেতে থাকত। আদরের রিক্তা শখের জিনিসের জন্য বাবা-মায়ের কাছে প্রায় সময় বায়না ধরত। তারাও সচেষ্ট ছিলেন সাধ্যের মধ্য থেকে মেয়ের শখ-আহ্লাদ পূরণে।
বাবা রজ্জব মোল্লা নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা বাজারের ব্যবসায়ী। ব্যবসার কাজে তাকে মোটরসাইকেল চালাতে হতো। সেই সময়টাতে মোটরসাইকেলের খুব একটা প্রচলন ছিল না। গ্রামে এক-দুটি মোটরসাইকেল দেখা যেত। ছোট্ট রিক্তা, সে সময়ে কেবল ক্লাস ফোরে পড়ে। একদিন রিক্তা বাবার কাছে মোটরসাইকেল চালানো শেখার বায়না ধরে। তখন বাবা মোটরসাইকেল চালানো না শিখিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে কিনে দেন বাইসাইকেল। সেই থেকে সাইকেল নিয়ে সারা দিন ছোটাছুটি করে বেড়াত রিক্তা।
শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা থেকে হঠাৎ করে কিশোরী রিক্তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে রিক্তার বাবাও ব্যবসা ছেড়ে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যান। ৪ বছরের ব্যবধানে রিক্তার কোলজুড়ে আসে ২ পুত্রসন্তান। সবই ঠিকঠাক চলছিল সবই। হঠাৎ খবর আসে রিক্তার বাবার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে। সেই দূরদেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয়। বাবার চিকিৎসার জন্য ধারদেনা করে দেশ থেকে টাকা-পয়সা পাঠানো হয় বিদেশে। ২০১৪ সালে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান রিক্তার বাবা রজ্জব মোল্লা। বাবা মারা যাওয়ার পর ওই পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
এদিকে রিক্তার বৈবাহিক জীবনেও নানা টানাপড়েন শুরু হয়! নানা বিষয়া নিয়ে বরের সঙ্গে দিনকে দিন বাড়ে দূরত্ব। রিক্তার নতুন করে ভাবতে হয়। মাথায় আসে স্বনির্ভর হওয়ার। রিক্তা সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু সে মোটরসাইকেল চালাতে পারে সে জন্য সে নারীদের স্কুটি (ব্যাটারিচালিত) বা মোটরসাইকেল চালানো প্রশিক্ষণ দেবেন। একটি স্কুটি কিনে নেমে পড়েন বাবার শেখানো পথে। দোহার ও নবাবগঞ্জে নারীদের গত চার বছর ধরে স্কুটি চালনায় প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এ দুটি উপজেলার শতাধিক নারীকে এ পর্যন্ত স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালানো প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। এদের কেউ পেশাজীবী আবার কেউ কেউ কেবলই ছাত্র। রিক্তার হাত ধরেই দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালানোর দৃশ্য এখন সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অনলাইনের পণ্য ডেলিভারি ও অফিসিয়াল কাজে স্কুটি ও মোটরসাইকেল দেদার চলাচল করছে নারীরা।
কর্মজীবী নারীদের মধ্যে আঁখি আক্তার জানান, আমার দুই সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া ও অফিস স্কুটি দিয়ে করতে হচ্ছে। একটা সময়ে রিকশাযোগে এসব কাজ করতাম। এখন স্কুটি চালানো শেখার ফলে আমি নিজেই সব কাজ করতে পারছি।
স্বনির্ভর নারীদের নিয়ে পত্রপত্রিকা ও টিভিতে যত কথা হয়, তাদের যতখানি এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেওয়া হয়, সে তুলনায় অগ্রসর নারীদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মেনে ও মানিয়ে নেওয়া নিয়ে কথা বলার চর্চা এখনও অপ্রতুল।
ফলে নারী যখন সচেতন ও স্বনির্ভর তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক যুদ্ধ যেন একান্তই ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নারীটি সফল হয়ে উঠলে সেই সাফল্যের ভাগীদার হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন সবাই। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে নারীকে এই একক যুদ্ধে ঠেলে দিয়ে তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়ার কাজটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র করে থাকে। বদলে যাওয়ার এ সময়ে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা দরকার বলেও মনে করেন রিক্তা। কিছুদিন আগে বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে তার। প্রশিক্ষণের কাজটি এখন আরও মনোযোগ দিয়ে করতে চান তিনি।
রিক্তার মতো অন্য নারীরা যাতে ভবিষ্যতে স্কুটি বা মোটরসাইকেল চালানোর কাজটি নির্বিঘ্নে করতে পারেন সে বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান তিনি।
দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় সপ্তাহে শুক্রবার প্রশিক্ষণ সেন্টার চালু করেছেন রিক্তা। দোহারে, জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ও নবাবগঞ্জে, সরকারি দোহার-নবাবগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে চলে এসব প্রশিক্ষণ। ১৫ দিনের এসব প্রশিক্ষণে স্বাচ্ছন্দ্যে স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালানো শেখেন নারীরা। বর্তমানে প্রশিক্ষণ নিয়েই এককভাবে কাজ করছেন রিক্তা। এ আয়েই চলে তার সংসার।
রিক্তা জানান, আমাদের সমাজের নারীরা সবসময়ই অবহেলিত। তাদের মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হয়। নারীদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব হলে সমাজে আর নারীদের হেয়প্রতিপন্ন হতে হবে না।
সময়ের আলো/জিকে