নিজস্ব লাইটার ট্যাঙ্কার অচল হওয়ায় দৈনিক ২৬ হাজার মার্কিন ডলারে বিদেশি ট্যাঙ্কার ভাড়া করল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। চড়া মূল্যে ট্যাঙ্কার ভাড়া করায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ব্যয়ের খাত বড় হচ্ছে। পাশাপাশি দুটির পরিবর্তে একটি ট্যাঙ্কারে অপরিশোধিত জ্বালানি (ক্রুড) খালাস করা হচ্ছে। এতে বিপুল ডেমারেজ (ক্ষতিপূরণ) গুনতে হবে বিপিসিকে। পাশাপাশি ট্যাঙ্কারের ভাড়া ও ডেমারেজ দুই খাতেই বাড়তি ব্যয়ের মুখে পড়ল বিপিসি। বিপিসির পক্ষে বিএসসি কেবল ট্যাঙ্কার ভাড়া করেছে। বাড়তি ব্যয় ও ডেমারেজের পুরো ব্যয় বিপিসিকেই বহন করতে হবে।
গভীর সাগরে নোঙর করা মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাসে একটি ছোট ট্যাঙ্কার কাজ শুরু করেছে। এর নাম ‘এমটি গ্লোবাল ডিগনিটি’। পানামার পতাকাবাহী ট্যাঙ্কারটির দৈনিক ভাড়া ২৬ হাজার মার্কিন ডলার। মাদার ট্যাঙ্কার থেকে ভাড়া করা লাইটার ট্যাঙ্কারটি নির্ধারিত সময়ের ৯ দিন পর ক্রুড খালাস শুরু করেছে। বিপিসির পক্ষে বিএসসি লাইটার ট্যাঙ্কারটি ভাড়া করে। এটি একবার সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টনের বেশি ক্রুড পরিবহন করতে পারে না। অচল দুই ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ এক সঙ্গে ২৫/২৬ হাজার টন ক্রুড পরিবহন করতে পারত। বিএসসির নিজস্ব ট্যাঙ্কার অচল। তাই বাড়তি ব্যয়ের পাশাপাশি বাড়তি সময় লাগছে ক্রুড খালাসে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মাদার ট্যাঙ্কার থেকে সময়মতো ক্রুড খালাস করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে বিএসসি বলছে, দ্রুত সময়ে ক্রুড খালাসের জন্য লাইটার ট্যাঙ্কার ভাড়া করা হয়েছে। এখানে ট্যাঙ্কারে ক্রুড পরিবহনে দৈনিক ভাড়ার চেয়ে দ্রুত ক্রুড খালাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের দুটি লাইটার ট্যাঙ্কার অচল হওয়ার পর বহির্নোঙরে এসে যায় একটি মাদার ট্যাঙ্কার। এই ট্যাঙ্কার থেকে দ্রুত ক্রুড খালাসে কত ভাড়ায় ট্যাঙ্কার যুক্ত করা হচ্ছে সেটা বিবেচনা করতে পারছি না। তবে আমরা পরবর্তী চালানের ক্রুড খালাস করব টেন্ডারের মাধ্যমে ট্যাঙ্কার ভাড়া করে। এতে ভাড়া বাবদ এত বেশি অর্থ ব্যয় হবে না।
একটি মাত্র লাইটার ট্যাঙ্কার দিয়ে ক্রুড খালাস করার কারণে ডেমারেজ কত আসতে পারেÑএ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএসসির সঙ্গে ভাড়া চুক্তি অনুযায়ী ডেমারেজ দিতে হয়। তবে আমরা সামনে নতুন চার্টার পার্টি এগ্রিমেন্ট (ভাড়া চুক্তি) করার চিন্তা করছি। যাতে ডেমারেজ প্রদানের কোনো শর্ত থাকবে না।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে দুর্ঘটনায় অচল হয়ে যায় বিএসসির লাইটার ট্যাঙ্কার ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’। পাঁচ দিনের মাথায় দুর্ঘটনায় অচল হয় এমটি বাংলার সৌরভ। এমটি বাংলার জ্যোতি-সৌরভ অচল হওয়ার সময় একটি মাদার ট্যাঙ্কার বহির্নোঙরে নোঙর করা ছিল। এর নাম এমটি ‘ওমেরা লিগেসি’।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেবলদানা বন্দর থেকে আসা মার্বান ক্রুডবাহী ট্যাঙ্কারটি গত ১৭ সেপ্টেম্বর কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে ভেড়ে। এক লাখ টন ক্রুড খালাস শেষে চলে যাওয়ার কথা ছিল ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। কিন্তু দুর্ঘটনায় জ্যোতি বিকল হওয়ায় ক্রুড খালাসে সময়ক্ষেপণ শুরু হয়। ক্রুড লাইটারিং চলে একটি মাত্র ট্যাঙ্কার বাংলার সৌরভের মাধ্যমে। সৌরভের মাধ্যমে ধীরগতিতে ক্রুড খালাস চলার সময়ই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। গত ৫ অক্টোবর রাতের অগ্নিকাণ্ডে সৌরভও বিকল হয়ে পড়ে। বর্তমানে দুটি ট্যাঙ্কারে ক্রুড পরিবহনের মতো অবস্থা নেই। মেরামত করেও আর বহরে যুক্ত করা যাবে না বলে বিএসসির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সৌরভ অচল হওয়ার সময় বিপিসির আমদানি করা প্রায় এক লাখ টন ক্রুড নিয়ে গভীর সাগরে ভেড়ে মাদার ট্যাঙ্কার ‘এমটি নরডিক কাফটার’। সৌদি আরবের রাস্তানুরা বন্দর থেকে আসা ট্যাঙ্কারটির ক্রুড খালাস অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে তড়িঘড়ি করে বিএসসি ক্রুড খালাসের জন্য একটি লাইটার ট্যাঙ্কার ভাড়া করে।
বিএসসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পানামার পতাকাবাহী ট্যাঙ্কার ‘এমটি গ্লোবাল ডিগনিটি’ দৈনিক ২৬ হাজার মার্কিন ডলারে ভাড়া করা হয়। ক্রুড পরিবহনে জ্যোতি-সৌরভে যে ব্যয় হতো তার চেয়ে অনেক বেশি দৈনিক ভাড়া। মাদার ট্যাঙ্কার গভীর সাগরে চলে আসায় চড়া মূল্যে দ্রুত লাইটার ট্যাঙ্কার ভাড়া করা ছাড়া বিকল্প ছিল না।
ট্যাঙ্কারটি কীভাবে ভাড়া করা হয়-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা ফার্নেস অয়েল নিয়ে এসেছিল। খালাস শেষে নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তে বাংলার সৌরভ অগ্নিকাণ্ডে অচল হয়ে পড়ে। নিজস্ব দুটি লাইটার ট্যাঙ্কার অল্প সময়ের ব্যবধানে অচল হওয়ায় দ্রুত লাইটার ট্যাঙ্কার খুঁজতে থাকে বিএসসি। অবশেষে ‘এমটি গ্লোবাল ডিগনিটি’র খোঁজ মেলে। চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা সেই লাইটার ট্যাঙ্কারটি দৈনিক ভিত্তিতে চড়া মূল্যে ভাড়া করে বিএসসি। গত ৪ অক্টোবর মাদার ট্যাঙ্কার এমটি নরডিক কাফটার গভীর সাগরে ভেড়ে। লাইটার ট্যাঙ্কার ভাড়া করতে দেরী হওয়ায় এর ক্রুড খালাস শুরু করতেও দেরী হয়ে যায়। গত ৫ অক্টোবর ক্রুড খালাস শুরুর শিডিউল থাকলেও মাদার ট্যাঙ্কারের ক্রুড খালাস শুরু হয় গত ১৪ অক্টোবর থেকে। দেরীতে ক্রুড খালাস শুরু হওয়ায় মাদার ট্যাঙ্কারটি চট্টগ্রাম ত্যাগ করতে অন্তত ৬/৭ দিন দেরী হবে। এ সময় প্রতিদিনের জন্য বিপিসিকে ডেমারেজ বা ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। ৬ দিন হিসাব করলে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ৬০ হাজার ডলার ডেমারেজ গুনতে হবে বিপিসিকে।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, একটি বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে সাগরের তলদেশে জ্বালানি তেল পরিবহনের কাজ শুরু করার চেষ্টা চলছে। গত বছর পাইপ লাইনে ক্রুড পরিবহন শুরুর কথা থাকলেও হয়নি। এই পাইপ লাইনে পরিবহন শুরু না করা পর্যন্ত ক্রুড পরিবহনে জটিলতা থেকেই যাচ্ছে।
অন্যদিকে দ্রুত লাইটার ট্যাঙ্কার ভাড়া করায় দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) ক্রুড ঘাটতির আশঙ্কা কেটে গেছে। দুই ট্যাঙ্কার বিকল হওয়ার পর ইআরএলের স্টোরেজ ট্যাঙ্কে ক্রুডের মজুদ সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। ক্রুড খালাস বন্ধ থাকলে ইআরএলে জ্বালানি তেল পরিশোধন বন্ধের মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
ইআরএলের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেল দিয়ে দেশের বার্ষিক চাহিদা পূরণ হয় না। চাহিদার জ্বালানি তেলের একটি অংশ আসে ইআরএল থেকে। ক্রুড পরিশোধন করে ইআরএলে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল, অকটেন এবং ফার্নেস অয়েল উৎপাদন হয়। উপজাত জ্বালানি হিসেবে উৎপাদন হয় বিটুমিন, এলপিজি ন্যাফতাসহ আরও কয়েক ধরনের জ্বালানি। বিমানের জ্বালানি জেট ফুয়েল উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া উৎপাদন হয় না। গত এক বছর ধরে বন্ধ আছে জেট ফুয়েল উৎপাদন।
সময়ের আলো/আরএস/