সেই ইলতুৎমিশ এখনও রয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন ভয়ানক মারমুখী। চাঁদাবাজি, দলবাজি, মাদকের কারবার থেকে বখরা নেওয়া কিংবা জমি বেদখলে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত হত্যকাণ্ডেও জড়িয়ে আছে তার নাম। অর্থাৎ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েও সব অবৈধ কর্মকাণ্ডে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অতিরিক্ত কমিশনার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) হেডকোয়ার্টার ইলতুৎমিশ। সাতক্ষীরায় বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি তিনি। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন মারমুখী। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা কাণ্ডে তিনি বিতর্কিত। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছিলেন আগ্রাসী ভূমিকায়। ছিলেন সাবেক পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুলের ক্যাশিয়ার। ‘আওয়ামী পরিবারের লোক’ পরিচয়ে গত ৪ বছর বুক ফুলিয়ে বহু অপকর্মের হোতা ওই পুলিশ কর্মকর্তা এখনও বহল রয়েছেন জিএমপিতে। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে বিভিন্ন মহলে।
বিসিএস ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ২০২০ সালের জুন মাসে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে (জিএমপি) যোগ দেন উপ-কমিশনার (ডিসি) পদে। পরে তাকে জিএমপির লোভনীয় টঙ্গী (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। জমি দখলে মদদ, মাদক কারবারিদের লালনসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে ২০২১ সালের জুলাই মাসে তাকে ডিসি হেডকোয়ার্টার পদে ফিরিয়ে আনা হয়। গত তিন বছর ধরে তিনি ওই দায়িত্বে রয়েছেন।
জানা গেছে, জিএমপিতে যোগদানের আগে মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ছিলেন সাতক্ষীরার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পুলিশ সুপার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুচপুকুর গ্রামের বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবিরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গত ২৫ আগস্ট ইলতুৎমিশ, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও সদর থানার সাবেক ওসি মহিদুল ইসলাম, জেলা জজ কোর্টের সরকারী কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল লতিফসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহতের ভাই মো. আজগর আলী। সাতক্ষীরা আমলি আদালত-১-এর বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য সাতক্ষীরা সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী সমিতির সদস্য ও মামলার ফাইলিং ল’য়ার অ্যাডভোকেট সামছুদ্দোহা খোকন দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, এটি ছিল একটি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’। মামলার বিবরণে বাদী উল্লেখ করেছেন, সাতক্ষীরা সদরের কুচপুকুর গ্রামের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বিএনপি কর্মী ছিলেন। ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে তাকে আটক করে নিয়ে আসেন সদর থানার তৎকালীন পরিদর্শক মহিদুল ইসলাম। পরে তাকে হত্যার ভয় দেখিয়ে স্ত্রী চম্পা খাতুনের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চম্পা খাতুন ৫ লাখ টাকা জোগাড় করে দেন। পরে বাকি টাকা না দেওয়ায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হুমায়ুনের বুকে ও পিঠে গুলি করে হত্যা করেন। পিপি আবদুল লতিফ ছিলেন এ হত্যাকাণ্ডের একজন পরিকল্পনাকারী।
তিনি বলেন, ওই সময় পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইলতুৎমিশের নির্দেশনা ছাড়া ওসি কখনো এই ধরনের কাণ্ড করতে পারেন না।
সাতক্ষীরা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী সমিতির সদস্যরা জানান, পট পরিবর্তনের আগে তারা সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের হয়েই দমন-নিপীড়ন করতেন। ইলতুৎমিশ, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, পরিদর্শক মহিদুল ইসলাম ও পিপি আবদুল লতিফ প্রতিদিনই কাকে ধরা হবে আর কাকে গ্রেফতার করা হবে সেসব পরিকল্পনা করতেন। পট পরিবর্তনের পর তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বর্তমানে অভিযুক্ত পিপি আবদুল লতিফ পলাতক।
ইলতুৎমিশ গাজীপুরে যোগ দিয়ে টঙ্গীর উপ-কমিশনার হওয়ার কিছুদিন পর সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি মহিদুল ইসলামকে বদলি করিয়ে নিয়ে আসেন টঙ্গীর পূবাইল থানায়। আর দায়িত্বে যোগ দিয়েই ওসি মহিদুল ও ডিসি ইলতুৎমিশ মিলে শুরু করেন জমি দখলবাণিজ্য। মহিদুল দায়িত্বে থাকার সময় পূবাইলে একের পর এক ডাকাতি শুরু হয়। গোটা এলাকা পরিণত হয় মাদক সাম্রাজ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূবাইলের এক ব্যবসায়ী বলেন, খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল মজিদের খিলগাঁও মৌজায় ৭-৮ বিঘা জমি ছিল। তিনি পর্যায়ক্রমে প্রায় সব জমি বিক্রি করে দখল বুঝিয়ে দেন। পরে ইলতৎমিশের সঙ্গে মিলে বিক্রি করা জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ইলতুৎমিশ ওসি মহিদুলকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল মজিদের জমি ছেড়ে দিতে হুমকি দেন। নইলে মামলা দিয়ে গ্রেফতারের হুমকি দেন।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে দোসর হিসেবে ইলতুৎমিশ আলেম-ওলামেদের চরিত্রও হরণে নামেন। গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া বক্তব্যের কারণে আলোচিত ‘শিশু বক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল জিএমপির গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি ও ১১ এপ্রিল বাসন থানায় আরও একটি মামলা করা হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার হলে সঙ্গে থাকা ৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করে পুলিশ।
১৩ এপ্রিল ডিসি ইলতুৎমিশ গাছা থানায় প্রেস বিফ্রিংয়ে জানান, মাদানির মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও এবং কুরুচিপূর্ণ পর্নোগ্রাফিতে ঠাসা। তিনি মিয়মিত এসব ভিডিও দেখতেন। এ কারণে মামলায় পর্নোগ্রাফি ধারাযুক্ত করেন ডিসি ইলতুৎমিশ এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ করেন মাদানি।
গাজীপুরের একজন পরিবহন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইলতুৎমিশ ছিলেন জিএমপির সাবেক কমিশনার বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ মোল্লা নজরুল ইসলামের চাঁদার ক্যাশিয়ার। গাজীপুরের তাকওয়া পরিবহন বাস কোম্পানির কাছে মোল্লা নজরুলের হয়ে ৮০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা দাবি করেন তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার দেলোয়ার হোসেন এবং ইলতুৎমিশ। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে ইলতুৎমিশের কাছে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এক দিন পর ইলতুৎমিশ টাকা ফিরত দিয়ে পুরো ৮০ লাখ টাকাই দিতে হবে বলে জানান। ওই টাকা না দেওয়ায় ২৫টি বাস ৭ মাস আটকে রাখে পুলিশ। চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় বহু শ্রমিককে। একের পর এক কমিশনার বদলি হলেও এখনও বহাল রয়েছেন ইলতুৎমিশ।
ইলতুৎমিশ টঙ্গীর ডিসি থাকার সময় টঙ্গী পূর্ব থানার সেকেন্ড অফিসার আশিক রোনাল্ডসহ তিন এসআই দত্তপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে উদ্ধার করা ফেনসিডিল গোপনে বিক্রি করে দেন। এমনকি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে আদায় করেন মোটা টাকা। গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিন এসআইকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটিকে প্রভাবিত করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গাছা থানার বোর্ড বাজারে গুলি-টিয়ার শেলে মারা যান ৯ জন। ওই সময় বোর্ড বাজার ও গাজীপুরা এলাকায় ইলতুৎমিশ নেতৃত্ব দেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষর্শী অভিযোগ করেন।
এসব বিষয়ে জানতে ডিসি মোহাম্মদ ইলতুৎমিশের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, সাতক্ষীরায় বিএনপি নেতাকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এ ছাড়া অন্য অভিযোগগুলোও অসত্য।
সময়ের আলো/আরএস/