ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন
সাগরে এলপিজির দুই ট্যাঙ্কারে রহস্যময় আগুন
অল্পের জন্য বড় বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা
প্রকাশ: সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪, ৩:২৯ এএম  (ভিজিট : ৩৬৮)
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে এলপিজিবাহী বড়-ছোট দুটি ট্যাঙ্কারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল জ্বালানি পুড়ে গেছে। গত শনিবার রাত ১২টা ৪২ মিনিটে আগুন লাগে দুটি ট্যাঙ্কারে। এলপিজির বড় ট্যাঙ্কার ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ থেকে গ্যাস ভর্তি করা হচ্ছিল ছোট লাইটার ট্যাঙ্কার সোফিয়ায়। এলপিজি ভর্তির সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে ট্যাঙ্কারের ৩১ ক্যাপ্টেন ক্রুকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। নাবিকদের মধ্যে বাংলাদেশির পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতের নাবিকও আছেন।

রোববার দুপুর ১টার দিকে বড় ট্যাঙ্কার ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’-এর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ছোট লাইটার ট্যাঙ্কার সোফিয়াতে আগুন জ¦লছিল। তবে সন্ধ্যার দিকে লাইটার ট্যাঙ্কারে আগুনের মাত্রা কমে আসে। ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। লাইটার ট্যাঙ্কারটির মালিক বসুন্ধরা গ্রুপ। বড় মাদার ট্যাঙ্কারটিতে বহন করা এলপিজি বসুন্ধরা গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা। শিপিং সেক্টরের সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্যাঙ্কারে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পর্যবেক্ষণে থাকা মেরিনার ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান রোববার সময়ের আলোকে বলেন, রোববার বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ছোট ট্যাঙ্কারে আগুন জ¦লছিল। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বড় ট্যাঙ্কার ক্যাপ্টেন নিকোলাসের আগুন রোববার দুপুরের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে আসে। ছোট ট্যাঙ্কারে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার আগে বড় বিস্ফোরণের আশঙ্কা করছি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, আগুন নেভাতে কোস্ট গার্ড নৌবাহিনীর পাশাপাশি বন্দরের উদ্ধারকারী টিম অংশ নিয়েছে। বন্দরের টাগবোটও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। এ ঘটনা  তদন্তে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বন্দর সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা এলপিজি নিয়ে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে নিয়মিত ভিড়ে মাদার ট্যাঙ্কার। এসব এলপিজি দেশের বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি বোতলজাত করে বাজারজাত করে। এরই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে এলপিজি নিয়ে ‘ভিএলজিএস ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ ভিড়ে গভীর সাগরে। এই বৃহদাকার ট্যাঙ্কার থেকে এলপিজি ভর্তি করা বা লাইটারিং করা হচ্ছিল ছোট ট্যাঙ্কার ‘বিএলপিজি সোফিয়া’য়। ক্যাপ্টেন নিকোলাস থেকে বড় রশি দিয়ে সোফিয়াকে বাঁধা হয়েছিল। সোফিয়াতে অবস্থান করছিল বসুন্ধরার মুরিং মাস্টার। শনিবার রাত ১২টা ৪২ মিনিটে ক্যাপ্টেন নিকোলাসের এলপিজির পাইপলাইনে আগুন ধরে যায়। আগুন বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা ছোট ট্যাঙ্কার সোফিয়াতে।

আগুন লাগার পর আতঙ্কে সোফিয়ার নাবিক, ক্যাপ্টেন নিকোলাসের ২ নিরাপত্তারক্ষী সাগরে ঝাঁপ দেন। এ সময় সোফিয়ার কাছে থাকা বসুন্ধরার আরেক ট্যাঙ্কার ‘বিএলপিজি চাতকি’র ক্যাপ্টেন ফরমান উল্লাহ আনসারী ট্যাঙ্কার নিয়ে দ্রুত ছুটে যান সোফিয়ার দিকে। ক্যাপ্টেন ফরমান উল্লাহ আনসারীর দ্রুত সিদ্ধান্তে তিনটি টাগবোট তুফান এক্সপ্রেস, সি ফাইটার-৩ ও সোনাইছড়ি-৪ এগিয়ে যায় ঝাঁপ দেওয়া নাবিকদের দিকে। পরে সোফিয়ার সব নাবিককে টাগবোটে তুলে নেওয়া হলে তারা বেঁচে যান। ক্যাপ্টেন ফরমান উল্লাহ তাৎক্ষণিক এ ঘটনা চট্টগ্রাম বন্দরের রেডিও কন্ট্রোল রুমসহ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে জানান। খবর পেয়ে শনিবার রাতেই সোফিয়ার কাছে ছুটে আসে কোস্ট গার্ডের অগ্নিনির্বাপক টাগবোট ‘বিজিসিএস প্রমত্ত’। রোববার ৩টা ৫৪ মিনিটে ‘প্রমত্ত’ আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। এ সময় আরও দুই টাগবোট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। পাঁচটি টাগবোট টানা ৪০ মিনিট সোফিয়া ও নিকোলাসে আগুন নেভাতে পানি ছিটায়। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও নৌবাহিনীর অগ্নিনির্বাপক টিমও কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। রোববার বিকাল সাড়ে ৫টায় ছোট ট্যাঙ্কারে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও থেকে থেকে জ্বলছিল। 

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, এলপিজির এসব ট্যাঙ্কারে নাশকতা করা এত সহজ না। যে নাশকতা করতে যাবে সে বিস্ফোরণে উড়ে যাবে। তবে অল্প সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা এবং গভীর সাগরে তিন ট্যাঙ্কারে আগুন লাগার বিষয়টি চিন্তার বিষয়। তদন্ত করলে পুরো ঘটনা বের হয়ে আসবে।

কী কারণে আগুন লাগতে পারে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, কারও অবহেলা আছে কি না দেখতে হবে। ট্যাঙ্কারে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয় এলপিজি বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস। এত সহজে এসব ট্যাঙ্কারে আগুন ধরে না।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অয়েল ট্যাঙ্কার বা এলপিজির ট্যাঙ্কারে কী কারণে আগুন লেগেছে তা তদন্ত না করে বলা কঠিন। গভীর সাগরে ক্যাপ্টেন বা কারও ভুলেও আগুন লাগতে পারে। তবে তদন্তের পর প্রকৃত কারণ বের করা যাবে।

আগুন লাগার কারণ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান বলেন, নিকোলাসের গ্যাস পাইপলাইন ফেটে আগুন লাগা রহস্যজনক। কারণ এসব পাইপ অপারেশনাল কাজে যুক্ত করার আগে উচ্চ চাপে টেস্ট করা হয়। যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় না পড়ে। নিকোলাসের ক্যাপ্টেন ও চিফ অফিসারের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। জাহাজটির সামনের রশি দুর্বল করে দেওয়ার একটি অভিযোগ শুনেছি। এতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় গ্যাস পাইপলাইনে। দুই ট্যাঙ্কারের কারও ভুলে বা পাইপে অতি চাপের কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার পেছনে কারও ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনার কারণ উদঘাটন করতে পারে।  

শিপিং সেক্টর সংশ্লিষ্টরা জানান, এলপিজি পরিবহন থেকে খালাস সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা অবলম্বন করা হয়। খালাস বা ভর্তির ক্ষেত্রে নিয়মের সামান্য লঙ্ঘন হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর, কোস্ট গার্ড বা নৌবাহিনীর কাছে তেল-গ্যাসের আগুন নেভানোর কোনো অগ্নিনির্বাপক টাগবোট নেই। টাগবোটগুলো কেবল এলপিজির ট্যাঙ্কারে আগুন নেভাতে পানি ছিটানোর কাজ করতে পারে। 

এদিকে এলপিজির ট্যাঙ্কারে দুর্ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রোববার গঠিত এই কমিটির প্রধান বন্দরের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর এম ফজলার রহমান। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা এবং গভীর সাগরে মোট তিনটি লাইটার ট্যাঙ্কারে আগুন ধরে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কার বাংলার জ্যোতিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে। ওই ঘটনায় একজন ডেক ক্যাডেটসহ বিএসসির তিন কর্মীর মৃত্যু হয়। পাঁচ দিনের মাথায় ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে লাইটার ট্যাঙ্কার এমটি ‘বাংলার সৌরভ’-এ আগুন লাগে। বিএসসির দুটি লাইটার ট্যাঙ্কারে অগ্নিকাণ্ডের জন্য নাশকতাকে সন্দেহ করেন খোদ বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক। দুর্ঘটনার দিন দুপুরে চট্টগ্রামে বিএসসির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলার সৌরভে দুর্ঘটনার জন্য নাশকতাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সৌরভের পাশাপাশি জ্যোতির অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। দুই ট্যাঙ্কারে আগুন লাগার রহস্য বের না হতেই আগুন ধরে এলপিজির ট্যাঙ্কারে। 

সময়ের আলো/আরএস/ 






https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close