ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছে ইলিশ ধরা। যা অব্যাহত থাকবে আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত। এ সময় ইলিশ মাছ ধরা, পরিবহন, বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পন্ন নিষিদ্ধ থাকবে।
এতে বেকার হয়ে পড়বে ভোলার মনপুরা উপজেলার মেঘনার পাড়ের কয়েকশ জেলে। যে কারণে অভাব-অনটন আর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বেন তারা। এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে তাদের কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ। তবে নিষেধাজ্ঞার সময়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল দেওয়া হবে। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক ও এনজিওগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেলেরা বলছেন, এবার ভরা মৌসুমে মনপুরা সংলগ্ন মেঘনা নদীতে ইলিশ কম থাকায় অনেকেই দেনার দায়ে জর্জরিত। এরই মধ্যে আবার ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলে আশায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা। জানা যায়, প্রজনন মৌসুম হিসেবে মা ইলিশ রক্ষায় টানা ২২ দিন সারা দেশে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। মাছ ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে গত কয়েক দিন ধরেই মাছঘাটগুলোতে সচেতনতামূলক মাইকিং ও ঘাটে ঘাটে ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
জেলে ও মৎস্যজীবীদের নিয়ে করা হয়েছে সভা ও সেমিনার। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক ও এনজিওগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
এদিকে নদীতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মনপুরার জেলেরা আড়তদারের দাদন ও এনজিওর ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার জেলেদের জন্য ২৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিলেও সব জেলে এ চাল পায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। যেসব জেলে সরকারি বরাদ্দের চাল পায়, তারাও এক সপ্তাহের বেশি এ চাল দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। ফলে অভিযানের সময় ঋণের বোঝা আরও ভারী হয় জেলেদের।
মনপুরার বিভিন্ন মাছ ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, ২২ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকবে আর তাই ঘাটে ভেড়ানো হচ্ছে নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ আবার শেষবারের মতো মাছ ধরতে নদীতে যাচ্ছেন। তবে তাদের ফিরতে হবে আজ রাত ১২টার আগেই। কেউ কেউ আবার আগে থেকেই জাল, নৌকাসহ মাছ ধরার সব উপকরণ তুলে এনেছেন ঘাটে।
সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানতে প্রস্তুত থাকলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে দিন কাটাবেন সে চিন্তার ছাপ রয়েছে জেলেদের চোখে-মুখে। সংকট দূর করতে নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলে পুনর্বাসনের চাল দ্রুত বিতরণের দাবি জেলেদের।
মনপুরা উপজেলা দক্ষিণ সাকুচিয়ার জেলে মো. ইসমাইল মাঝি জানান, নদীতে নামার সময় এনজিও থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা নদীতে নামাতে হয়েছে । এ বছর নদীতে তেমন মাছের দেখা মেলেনি। ১৫-২০ দিন আগ থেকে কিছু মাছ ধরা পড়ছে। তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। নয় সদস্যের পরিবারের খরচ জুগিয়ে সপ্তাহে ৩ হাজার টাকা এনজিওর কিস্তি দিতে হয়। এতে করে অনেকটা টানাপড়েনের মধ্যেই দিন যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষা অভিযান দিয়েছে। এই ২২ দিনে নতুন করে আরও দেনা করতে হবে। সরকার যে চাল দেয় তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৫-৬ দিন চলে। তবে বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে দাম এত করে চাল দিয়ে কি সংসার চালানো যাবে?
জানা গেছে, মনপুরায় নিবন্ধিত জেলে ১৪ হাজার ৩৪৭ জন থাকলেও চাল বরাদ্দ হয়েছে ১১ হাজার ৫০ জন জেলের নামে। নিবন্ধিত হয়েও অনেকের ভাগ্যে জুটবে না পুনর্বাসনের চাল। আর তাই অনেক জেলেকেই কাটাতে হবে অনেকটা ধার-দেনা করে। পেশায় জেলে হলেও অনেকে নিবন্ধিত হতে পারেনি এমন জেলের সংখ্যা রয়েছে অনেক। তাদের অভিযোগ-জেলে নিবন্ধনের সময় ৫০০ টাকা করে নেওয়ায় তাদের কাছে টাকা না থাকায় তারা নিবন্ধিত তালিকায় আসতে পারেননি।
জনতা ঘাটের সমুদ্রগামী জেলে মজিদ মাঝি সময়ের আলোকে জানান, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাগরে মাছ শিকার করে স্ত্রী ছেলে-সন্তান নিয়ে তিন বেলা খেয়ে কোনোমতে দিন চলে। আগে বঙ্গোবসাগরে অনেক মাছ ধরা পড়ত। গত ২ বছর সমুদ্রে তেমন মাছ নেই। তাই পুরো বছর ঋণের বোঝা টানতে হয় তাদের। সাগরে যে মাছ পাওয়া যায় তা বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন। উল্টো বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।
মনপুরা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৃজন সরকার সময়ের আলোকে জানান, শনিবার মধ্যরাত থেকে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে আগামী ২২ দিন মনপুরা মেঘনা নদীতে মা-ইলিশ রক্ষা অভিযান চলবে। এ অভিযান সফল করতে ও জেলেদের সচেতন রাখতে বিভিন্ন ঘাটে প্রচার চালানো হয়েছে। আমরা ২২ দিনের মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা অভিযান কঠোর করার জন্য সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। যারা সরকারি আইন অমান্য করে নদীতে গিয়ে মাছ শিকার করবে তাদের জেল ও জরিমানা করা হবে ।