আজকাল মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইসংক্রান্ত গ্রুপগুলোতে একজন লেখকের ঘুরে-ফিরে দুয়েকটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ছবিগুলোর সঙ্গে যে ক্যাপশন সংযুক্ত থাকে, তার মাজেজা হলো- এত সুন্দর, স্মার্ট যে বাঙালি লেখক হতে পারে, তা চিন্তাই করা যায় না। অথচ সে কি না লিখেছে গ্রামবাংলা নিয়ে। লিখেছে পীর, হুজুরদের নিয়ে। এই লেখক আর কেউ নন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২- ✔ ১৯৭১)।
একজন লেখকের সার্থকতা নির্ণয়ে তার সৌন্দর্য, স্মার্টনেস নির্ণয়ের কোনো ভূমিকা আছে কি না, জানা নেই। তবে ওয়ালীউল্লাহর সৌন্দর্য সত্যিই নজর কাড়ার মতো। যদিও একজন লেখক নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই গৌণ বা এর প্রয়োজন আছে বলে কোনো প্রয়োজন মনে করি না। যেহেতু ইদানীং তার ছবি নিয়ে নতুন করে আলাপ উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তাই বলার প্রয়োজন মনে করি যে, ওয়ালীউল্লাহর দৈহিক সৌন্দর্যের মতো তার লেখা এখনও আবেদনময়। জীবন্ত। যদিও এক সময় অনেক সমালোচকই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের ভাষা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন।
বলেছেন, তিনি বিদেশে থাকার কারণে স্বাভাবিক বাংলাও ভুলে গেছেন। যারা এসব বলেছেন, তাদের কেউ কেউ এখন কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আছেন। তার রচনাসম্ভার নিয়ে এখনও পাঠকের দরবারে উপস্থিত। তার 'লালসালু' কিংবা 'বহিপীর' এখনও বাঙালি পাঠককে আনন্দসুধা নিয়ত দান করে যায়। হয়তো যাবে বাংলা ভাষায় অদূর ভবিষ্যতেও, যতদিন বাংলা ভাষা বয়ে চলবে পৃথিবীর বুকে, মানুষের মুখে মুখে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্আয়ু পেয়েছিলেন কম। মাত্র উনপঞ্চাশ বছর। তার রচনার পরিমাণও বেশি নয়। উপন্যাস লিখেছেন তিনটি। 'লালসালু' (১৯৪৮), 'চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪), 'কাঁদো নদী কাঁদো'(১৯৬৮)। ছোটগল্পের বই দুটি। 'নয়নচারা' (১৯৪৪),'দুই তীর। ও অন্যান্য গল্প' (১৯৬৫)। তিনটি নাটক।
'বহিপীর' (১৯৬০), 'তরঙ্গভঙ্গ' (১৯৬৪) ও 'সুড়ঙ্গ'(১৯৬৪)। এ ছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বেশকিছু অগ্রন্থিত গল্প পরবর্তী সময়ে গ্রন্থিত করা হয়। এবংইংরেজিতে লেখা তার একটি উপন্যাস 'কদর্য এশীয়' নামে বাংলা অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। যদিও সেই বইয়ের কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি কোথাও। অধ্যাপক মশাইগণও প্রথম তিন উপন্যাস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কেননা তাদের ছাত্রাবস্থায় ওই বইটি তখনও আলোর মুখ দেখেনি। তাই পড়াতে এসে যা পড়ে এসেছেন, তার বাইরে আর তারা কষ্ট করে যেতে চান না। যাক সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাবের সময়টা দেখলে বোঝা যায়, তিনি এক উত্তাল সময়ের সন্তান। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'নয়নচারা' প্রকাশিত হয় পরাধীন ভারতবর্ষে।
১৯৪৪ সালে। তার দ্বিতীয় বই, প্রথম উপন্যাস। 'লালসালু' প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। দেশভাগের এক বছর পর। যুগের হাওয়া একজন লেখককে উন্মাতাল করবেই। মূলত কবি, যুগকে ধারণ করেই যুগন্ধর হয়। এবং ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভূমিকা কতটুকু ছিল তা বোঝা যায় তারই সমসাময়িক ঔপন্যাসিক শওকত ওসমানের একটি কথায়। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত 'দেশ' পত্রিকার একটি গদ্যে শওকত ওসমান লিখেছেন: 'বাঙালি-মুসলমানের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে সত্যিকারের চেতনা নির্মাণের দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাদের অন্যতম মহৎ কারিগর।' এখানে শওকত ওসমানের একটি ভাষ্য লক্ষণীয়। তিনি ওয়ালীউল্লাহকে আধুনিক চেতনা নির্মাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এবং আমরা বলতে চাই, আধুনিক চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই, তার লেখা বর্তমান পাঠকের কাছে এখনও আদরণীয়। যদিও তার লেখার বিষয়বস্তু গ্রামের জনজীবন।
০২.
যখন স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়ি, তখন বড় মামার পুরোনো বইয়ের স্তূপের মধ্যেই প্রথম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু' দেখি। সেই প্রথম আমার ওয়ালীউল্লাহ্ দর্শন। বইয়ের ওপরে একটি নারীর ছবি আঁকা। নারী বসে কাঁথা সেলাই করছে। পেছনে সম্ভবত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি ছবি সংযুক্ত ছিল। না। তখন সেই বই পড়া হয়নি। পরে... ততদিনে কলেজে উঠে গেছি, এক মুদির দোকানে, সেই দোকানে বসে আড্ডা দিতাম, কাগজের ভিড়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ 'লালসালু'র সেই কলেজসংস্করণ পাই, যা মামার বইয়ের মধ্যে দেখেছিলাম। দোকানটি ছিল হারুন ভাইয়ের। উনি অবশ্য আমাকে ভাতিজা বলে সম্বোধন করতেন। তখন বই পড়ার প্রচণ্ড নেশায় পেয়ে বসেছে। পড়ার মতো বই হাতে নেই। তাই একই বই বারবার পড়ি।
আমি হারুন ভাইয়ের কাছে বইটি ধার চাইলাম। বললাম, পড়ে ফেরত দেব। উনি বললেন, নিয়ে যাও। দিতে হবে না। বইয়ের শুরুতে শওকত আলীর একটি দীর্ঘ ভূমিকা ছিল। অনেক দিন বইটি আমার কাছে ছিল কিন্তু শতছিন্ন হয়ে যাওয়ায়, তাছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসসমগ্র কিনে ফেলার কারণে পরবর্তী সময়ে শওকত আলীর ভূমিকা ছিঁড়ে রেখে দিয়ে বইটি পুরোনো কাগজের সঙ্গে ফেলে দিই। তবে ভূমিকাটি এখনও আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হওয়ার ভূমিকাটি বলার কারণ ওই সময় ওয়ালীউল্লাহ্ পাঠ করে যতটা মুগ্ধ হয়েছি, এখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (লালসালু বহিপীর) পড়াতে গিয়ে দেখি, শিক্ষার্থীরা তেমনই মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধতার কারণ লালসালুর মজিদ কিংবা বহিপীর-এর পীর সাহেবের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ করতে পারার ক্ষমতা। মজিদ বা বহিপীর ওদের কাছে পুরোনো কালের মানুষ হয়ে যায়নি। এখানে অবান্তরভাবেই একজন কথাসাহিত্যিকের একটি উক্তি মনে পড়ল। তিনি 'লালসালু'র বড় ত্রুটি নির্ণয় করেছেন যে, লালসালু উপন্যাসে মজিদ একজন মাজার ব্যবসায়ী। অথচ তিনি নামাজের জন্যে কড়াকড়ি আরোপ করেন। গান নিষিদ্ধ করেন অথচ সারা বাংলাদেশে মাজার মানেই গানবাজনা।
এই বলে, মান্যবর কথাসাহিত্যিক কাম প্রাবন্ধিক মাজার এবং ধর্ম নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তার আলোচনা পড়ে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। কারণ তিনি যে তথ্য, তত্ত্ব উগরে দিয়েছেন সেই গদ্যে, তা একান্তই বুকিশ। অর্থাৎ পাঠনির্ভর। আর বাস্তবতা যে ভিন্ন হতে পারে, তা তার মনেই আসেনি। বইয়ের ভেতর দিয়ে তিনি জগৎকে দেখেন। তিনি যদি বইয়ের সঙ্গে পৃথিবীকে মিলিয়ে দেখতেন, তাহলে এই ভ্রান্তি হতো না। সবচেয়ে বড় কথা, যে প্রতিষ্ঠানে আমি শিক্ষার্থীদের এই 'লালসালু' পড়াই, তার পাশেই রয়েছে একটি মাজার। এবং সে মাজারে আমরা ছোটবেলা থেকে কখনো গানবাজনা হতে দেখিনি। বরং তারাও গানবাজনাবিরোধী। শুধু তা-ই নয়, মাজার কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে মসজিদ। আমরা যখন 'লালসালু' পড়ি, তখন কারোরই মনে হয় না, মজিদ অবাস্তব কোনো চরিত্র। এমন কোনো মানুষ বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে হয়তো এমন অনেক মাজারই আছে, যেখানে কোনো গানবাজনা হয় না। তাই যারা শুধু বইনির্ভর জ্ঞান দিয়ে সাহিত্য বুঝতে আসে, তাদের জন্যে করুণা হয়।
মজিদ কোনো টাইপড চরিত্র নয়। রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ সে। তাই তার মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। দ্বিধা আছে। সে সৎ থাকতে চেয়েছিল। পারেনি। কেননা আল্লাহর দুনিয়ায় তারও বাঁচার অধিকার আছে, এ জন্য সে ভয়ংকর এক খেলা খেলেছিল। কখনো কি মজিদের এ নিয়ে অপরাধবোধ জাগেনি, এক পুরো গ্রামের মানুষকে সে ঠকাচ্ছে ভেবে। জেগেছে বৈকি! রাগের মাথায় হলেও তার মনে হয়েছে, মানুষের এই মূর্খামি প্রকাশ করে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। যদিও তার নিজের খেলায় সে নিজেই বন্দি হয়ে গিয়েছিল। মজিদ নিজে পরিবর্তন হতে না পারলেও 'বহিপীর' নাটকের বহিপীর কিন্তু শেষপর্যন্ত অশেষ উদারতা দেখিয়েছিল। 'বহিপীর' নাটকে আমরা দেখতে পাই, বহিপীর তার সদ্য বিবাহিত তরুণী বউকে খুঁজতে বেরিয়ে ঘটনাক্রমে এক বজরায় আশ্রয় পান। বৃদ্ধপীরের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তাহেরা। সেও তখন সেই বজরায় উপস্থিত ছিল। বজরার মালিক হাতেম আলী তখন টাকা জোগাড়ের চিন্তায় অস্থির।
টাকা জোগাড় না হলে তার জমিদারি নিলামে উঠবে। ছেলেকে প্রেস করে দেওয়া হবে না। পীর সাহেব এসব ঘটনা জানতে পেরে প্রথমে হাতেম আলীকে লোভ দেখায়, তাহেরাকে তার হাতে তুলে দিলে সে জমিদারকে কাঙ্ক্ষিত টাকা দেবে। কিন্তু নাটকের শেষের দিকে দেখি পীর সাহেব কোনো শর্ত ছাড়াই হাতেম আলীকে টাকা দিয়ে নিজের মহানুভবতার পরিচয় দিচ্ছেন। মজিদের কথায় আসি। মজিদ আরবি লাইনে পড়ুয়া লোক। তার বিচরণ ক্ষেত্র গ্রাম। কিন্তু তার যে মানস গঠন তা অত্যন্ত জটিল এবং আধুনিক। তাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে শহরে ছেড়ে দিলে কী হতো? হ্যাঁ, মজিদ যদি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতো, তাহলে সে হতো বাবর আলী। যাকে সৈয়দ শামসুল হক 'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসে এঁকেছেন। অনাগত কোনো গবেষক হতো একদিন প্রমাণ করে দেখাতে পারবেন বাবর আলী মজিদেরই মানস সন্তান।
সময়ের আলো/আরএস/