ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

গাজা-ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তি
মৃত্যুঞ্জয়ী গাজা
প্রকাশ: সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪, ৩:৪৪ এএম  (ভিজিট : ১০৪)
‘আপনি যদি গাজার বাসিন্দা হন, আপনাকে মরতে হবে বারবার’, লিখেছেন ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহা। এটি তার নতুন কবিতা সংকলনের পঙ্ক্তি। বইটি প্রকাশ হবে ১৫ অক্টোবর, এই পর্যায়ের যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তির ৮ দিন পর। 

আজ ৭ অক্টোবর গাজা-ইসরাইল এই পর্যায়ের যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তি। গত বছরের এই দিনে ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসলামিক জিহাদ। হত্যা করে ১ হাজার ১৩৯ জনকে। একই সঙ্গে জিম্মি করে নিয়ে যায় দুই শতাধিক ইসরাইলিকে। ওই দিন থেকেই গাজায় শুরু হয় আগ্রাসন। তখন থেকে গতকাল ৬ অক্টোবর পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী, উপত্যকায় ইসরাইলি হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ হাজার ৮৭০ জন। আহত হয়েছে ৯৭ হাজার ১৬৬ জন। হত্যার শিকার যারা, তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রকাশিত আলজাজিরার হিসাব অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত হত্যার শিকারদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। 

নারী আর তার জরায়ু বরাবরই ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তু। নারীর গর্ভ থেকে বের হবে যে ফিলিস্তিনি শিশু, সেও তো ইসরাইলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করবে। অন্তত ঢিল কিংবা গুলতি দিয়ে লড়বে। সে কারণেই ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার অংশ হিসেবে নারী জরায়ুকে নিশানা বানায় জায়নবাদ। ঠেকাতে চায় জন্ম। তবে সফল হয় না। কেননা হত্যার বিপরীতে ফিলিস্তিনি নারীরা তাদের জরায়ুকে করে তোলে যুদ্ধাস্ত্র। ভবিষ্যতের প্রতিরোধ বাসনকে সঙ্গী করে নতুন নতুন শিশুর জন্ম দিতে থাকে তারা। এ বছরের শুরুতে (১৭ জানুয়ারি) দেওয়া ইউনিসেফের হিসাবে, হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর পর ১০৫ দিনে ২০ হাজার শিশুর জন্ম দেন গাজা উপত্যকার নারীরা। এই যে প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশুর জন্ম হয়, এভাবেই গাজার নারীরা হত্যার শিকার হওয়া মানুষদের ফাঁকস্থান পূরণ করে ফেলে। হাসপাতাল-মসজিদ-শরণার্থী শিবির, সবখানেই মৃত্যুর সঙ্গে তাদের বসবাস। সেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা জন্ম দিয়ে যায় শিশু। এগিয়ে যায় জীবনের পথে। এভাবেই গাজাবাসী হয়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী। দুনিয়া থেকে ফিলিস্তিন প্রশ্নকে নিশ্চিহ্ন করার যে আয়োজন, এভাবেই তা প্রতিরোধের মুখে পড়ে।  

আর. এ. কানানেহর সাড়া জাগানো বই ‘স্ট্র্যাটেজিজ অব প্যালেস্টানিয়ান ইউমেন ইন ইসরাইল’। বইতে কানানেহ বলেন, ফিলিস্তিনি নারীদের জরায়ুকে হুমকি হিসেবে প্রচার করে ইসরাইল। কেননা জায়নিস্ট রাষ্ট্রবাসনা আর সব জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের জন্ম রুখতে চায়। ২০১৪ সালে তৎকালীন ইসরাইলি আইনপ্রণেতা এয়িলেট শ্যাকেড সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে শত্রু ঘোষণা করেন। নারীদের হত্যার ডাক দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। তার সেই পোস্ট হাজার হাজার লাইক কুড়িয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ওই নারীদের হত্যা করতে হবে, কেননা তারা ‘সাপের বাচ্চা’র জন্ম দেয়। নারী অধিকারকর্মী নাদা এলিয়ার ২০১৪ সালে লেখা ‘এন্ডিং জায়নিজম ইজ অ্য ফেমিনিস্ট ইস্যু’ নামের নিবন্ধে শ্যাকেডের ওই মন্তব্যের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি সে সময় বলেন, পানি ও জরুরি ওষুধের সরবরাহ বন্ধ রেখে ব্যাপক গর্ভপাত ঘটানো, হাসপাতালের পথে থাকা ফিলিস্তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চেক পয়েন্টে বহু সময় ধরে অপেক্ষা করানো এবং ফিলিস্তিনিদের অমানবিক পরিস্থিতিতে বাস করতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শিশুহত্যা নিশ্চিত করার যে ইসরাইলি কাঠামো, তারই প্রতিফলন শ্যাকেডের ওই মন্তব্য।

ফিলিস্তিনিদের জন্ম রুখে দেওয়ার ‘ইসরাইলি কাঠামো’র বিপরীতে প্রতিরোধও প্রবল। এবারের যুদ্ধেও তার নজির দেখা গেছে। ইসরাইলি বিমান হামলায় মরতে বসেছেন; এমন অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভ থেকে জীবন্ত নবজাতক বের করে এনেছেন গাজার ডাক্তাররা। মা মরে গেলেও নবজাতক আইসিইউতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলেছে অপরিপক্ব শিশুদের বাঁচানোর। 

৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর প্রথমেই শুরু হয় অমানবিকীকরণ (ডিহিউম্যানইজেশন) প্রক্রিয়া। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের আখ্যা দেন ‘মানুষরূপী জানোয়ার’ (হিউম্যান অ্যানিমেল)। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার নাম দেন ‘শয়তানদের শহর’ (সিটি অব ইভিল)। সুতরাং ‘আত্মরক্ষার্থে’ এবার ‘শয়তানদের শহরে’ হামলে পড়ো, ‘মানুষরূপী জানোয়ার’দের নাশ করো; এভাবেই আগ্রাসনের নতুন পর্বের শুরুটা জায়েজ হয়। এই নাশকরণ প্রক্রিয়ার প্রথম বাস্তব প্রতিফলন ঘটে ১৭ অক্টোবর। ইসরাইল গাজার আল-আহরি আরব হাসপাতালকে এদিন নিশানা করে। বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে কয়েকশ’ ফিলিস্তিনিকে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘনিষ্ঠতম মিত্র ইসরাইলে উড়ে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কোনোরকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ইসরাইলি সুরে সুর মিলিয়ে বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেন, ‘হাসপাতালে হামলা আপনাদের নয়, ফিলিস্তিনে সশস্ত্র সংগঠনের কাজ।’ বিশ্লেষকদের মতে, ততক্ষণে অপরাধের সমস্ত তথ্যপ্রমাণ বিনাশ করা হয়ে গেছে ইসরাইলের। 

এরপর থেকে আর ইসরাইলকে থামতে হয়নি। একের পর এক হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, স্কুল কিংবা অন্য বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তারা হামলা চালিয়েছে। হত্যা করেছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। আর এই সবই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে, তাদের দেওয়া অস্ত্রেশস্ত্রে। সবশেষ গত আগস্টেও তারা ইসরাইলে ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ অনুমোদন করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানাবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২টি ইসরাইলি বিমান হামলায় ৪৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের আলামত হাজির করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম স্টেট ক্র্যাফটস সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে গাজায় ২০টি ইসরাইলি হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে। মার্কিন অস্ত্রে গাজায় চালানো ওই ২০ হামলায় যুদ্ধাপরাধের আলামত মিলেছে।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক আইনের সাবেক অধ্যাপক ও একসময়কার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত রিচার্ড ফক। তিনি যুদ্ধ শুরুর ২ মাস না পেরোতেই বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরাইলকে দেওয়া ফিলিস্তিনি জাতিগত নিধনের সবুজ সংকেত। ফিলিস্তিনি অ্যাকাডেমিশিয়ান সামি আল-আরিয়ান সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছিলেন, গাজার শিশুদের নিষ্পাপ রক্ত লেগে গেছে বাইডেন আর তার রক্তপিপাসু বন্ধুদের হাতে। তাদের মতে, “ফিলিস্তিনি শিশুদের বাঁচার অধিকার নেই। আপনাদের এই বর্ণবাদী অবস্থানকে জুতো মারি।”

গাজায় ক্ষুধাকে বানানো হয়েছে যুদ্ধাস্ত্র। চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতালগুলো রয়েছে, সেগুলোকে বানানো হয়েছে বোমাবাজির নিশানা। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ওসিএচিএর দেওয়া সাম্প্রতিক হিসেবে এ পর্যন্ত ৩ শতাধিক মানবিক সহায়তা কর্মী ও ৯০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। বাসিন্দাদের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১৯ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর থেকে ত্রাণ সরবরাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

২৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে গাজা সিটির কাছে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা একটি ত্রাণ বহরের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১১২ জন নিহত হয়। ইসরাইলের দাবি, ফিলিস্তিনিরা যখন ত্রাণবাহী ট্রাক থেকে ত্রাণ লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা তাদের সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতেই আতঙ্কিত হয়ে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘পদদলিত’ হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। তবে আলজাজিরা ও বিবিসি ভেরিফাই তাদের অনুসন্ধানে দেখিয়েছে, হত্যার উদ্দেশ্যেই ত্রাণপ্রত্যাশীদের গুলি করা হয়েছে। এভাবেই ক্ষুধা হয়ে উঠেছে ইসরাইলি যুদ্ধাস্ত্র।

গাজার কৃষিজমির ৭৫ শতাংশই বোমায় ধ্বংস করেছে ইসরাইল। জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধ শুরুর আগে গাজায় প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক খাবার প্রবেশ করত। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রতিদিন ঢুকেছে ৬৭টি ট্রাক। উত্তর গাজায় ত্রাণ সরবরাহ পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেছে। আলজাজিরা জানাচ্ছে, গাজায় এখন প্রায় সব মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। একেবারে খাদ্যহীন অবস্থায় রয়েছে ২২ শতাংশ মানুষ। 
গতকাল আলজাজিরার এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় নিজেদের খেলনা খাওয়ার ভান করছে গাজার শিশুরা। ‘আমি আপেল আর কলা খেতে পাচ্ছি না। আমি রুটি আর আইসক্রিম খেতে পারি না আর। আমার কাছে কেবল প্ল্যাস্টিকের খাবার (খেলনা খাবার) আছে। তবে আমার তো আসল খাবার দরকার।’ বলে এক শিশু। গাজার দেইর আল বালাহ থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আঞ্চলিক পরিচালক অ্যান্টোইন রেনার্ড আলজাজিরাকে বলেন, আসছে শীতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে উপত্যকার বাসিন্দাদের। 

ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহা তাই আলজাজিরার সাংবাদিক নিক হিলডেনকে বলেছেন, গাজায় আপনাকে বারবার মরতে হবে। কেননা আপনি যেকোনো সময় বোমা হামলায় মারা যেতে পারেন, কেবল ভাগ্যই আপনাকে রক্ষা করতে পারে। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আপনার আশারও মৃত্যু ঘটতে পারে। প্রতিদিন আপনাকে মৃত্যু চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে হয়। তাই মৃত্যুতেই গাজাবাসীর বসবাস।


সময়ের আলো/আরএস/






https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close