ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ইসরাইল কি নিজের কবর খুঁড়ছে
প্রকাশ: সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪, ৩:১৬ এএম  (ভিজিট : ১১২)
ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবের এক আমুদে শহরে লোকজন বাইরে বসে ডিনার করছেন। বাতাসে ভাসছে গ্লাসের ঠুংঠাং শব্দ আর গানের মিষ্টি সুর। হাসি-তামাশায় জীবন্ত চারপাশ। তবু যারা সেখানে আছেন তাদের চারপাশজুড়েই গাজায় জিম্মি হয়ে থাকা নাগরিকদের ছবি। কোনোটা সাঁটানো হয়েছে ল্যাম্পপোস্টে, কোনোটা আবার দোকানের জানালায়। ছবিগুলো তাদের পদে পদে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইসরাইল যুদ্ধে জড়িত এবং এক বছর আগে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত। হামাসের সঙ্গে ইসারাইলের যুদ্ধ যখন বছর পেরোচ্ছে তখন মনে হতেই পারে যে, দেশটিতে হয়তো এতদিনে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু মোটেই তা নয়।

গত বছরের আজকের দিনে ইসরাইলে হামাসের হামলার ঘটনায় এখনও অনেক ইসরাইলি ছটফটিয়ে মরছে। বহু জিম্মি এখনও হামাসের কব্জায় রয়েছে; অন্যদিকে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লেবাননে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। এরই মধ্যে যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করায় বহু ইসরাইলি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাদের ওপর ভর করেছে বিষণ্নতা আর হতাশা। তারা স্বাভাবিকতার বোধ বজায় রাখার চেষ্টা করলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যত প্রতিটি অংশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে ইসরাইল। বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্ট বলছেন, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করছে, শেষমেশ সেই বিশৃঙ্খলা তাকেই তাড়া করে বেড়াবে। 

ইসরাইলি অ্যাক্টিভিস্ট জিভ এঙ্গেলমেয়ার। বিভিন্ন পোস্টকার্ডে জিম্মিদের ছবি কিংবা ইসরাইলের নতুন বাস্তবতায় তার করা বিভিন্ন পোস্টকার্ড যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকে প্রেরণা দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, যুদ্ধাবস্থা নিয়ে সর্বদাই আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। এমনকি যারা কফির দোকানগুলোতে বসে আছে, তারাও এ নিয়ে বিড়বিড় করছে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এমনটা দেখতে পাই আমি। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে জড়িয়ে গেছে। 

হামাসের হামলায় ১২০০ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষকে অপহরণের ঘটনা-দেশের ওপর ইসরাইলিদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অনুভূতির ওপর চরম আঘাত। তার ওপর ইরান ও হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইয়েমেন থেকে হুথিদের ড্রোন হামলা, দেশের মধ্যেই গোলাগুলি এবং ছুরি হামলার ফলস্বরূপ ইসরাইলিরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ইসরাইলকে আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও দেখছে তারা।

হামাসের হামলার পর ইসরাইলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান বিভাজন কিছুটা শিথিল হলেও পরবর্তীতে তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সেখানে জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতির চুক্তির আহ্বান জানিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিক্ষোভ হচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষ ইহুদি ইসরাইলিরা সেসব বিক্ষোভ থেকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে জেরুজালেম-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইসরাইল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের সেপ্টেম্বরের এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরাইলের ৬১ শতাংশ ডানপন্থি ইহুদি নেতানিয়াহুর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করে। ইসরাইলিরা নিজস্ব ট্রমায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যুর পরও বেশিরভাগ ইসরাইলি গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞের দিকে খুব কমই মনোযোগ দেয়।

হামাসের হামলা ঠেকাতে না পারায় বহু ইসরাইলি তাদের নেতা এবং সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ। সে হামলার বছর পূর্তিতে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে সরকারি বিবৃতি আসবে এমনটাই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অনুষ্ঠান বিঘ্ন হবে এই ভয়ে স্মরণসভার অনুষ্ঠান হবে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াই, শোনানো হবে পূর্বে রেকর্ড করা বিবৃতি।

একটি জনপ্রিয় স্কেচ কমেডি শো’র নির্বাহী প্রযোজক মুলি সেগেভ বলেছেন,  যে জিনিসটি আমরা ৭ অক্টোবরে হারিয়েছি এবং আর ফিরে পাইনি তা হলো আমাদের নিরাপত্তার অনুভূতি। তবে সবকিছু সত্ত্বেও, আমরা এখানে এমন একটি জীবনযাপনে সক্ষম হয়েছি যা বেশ উন্মুক্ত এবং পশ্চিমী। বিশেষত তেল আবিবে আমরা যারা জীবনযাপন করছি আমরা এই সত্যটি নিয়ে তেমন একটা ভাবতে পারি না যে-আমাদের জীবন যুদ্ধ এবং সহিংস বিস্ফোরণের বিরতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।

সত্যি বলতে ইসরাইলিদের জীবন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই কাটছে। তারা একদিকে যেমন অর্ধনগ্ন হয়ে সমুদ্রসৈকতে ভিড় করছে, ক্যাফে-কনসার্টে হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছে কিংবা খেলাধুলায় মত্ত হচ্ছে; অন্যদিকে তেমনি আশপাশের বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে ঢু মারছে, সহিংসতা বাড়লেই স্কুল যাওয়া কিংবা স্থানীয় ভ্রমণকেন্দ্র এড়িয়ে চলছে। প্রায়ই তাদের কানে হৃদয় বিদীর্ণ করে এমন খবর আসছে। যেমন-আগস্টে ৬ জিম্মি কিংবা লেবাননে সেনাদের মৃত্যুর মতো খবর।

গত মঙ্গলবার জাফা শুটিংয়ে ৭ নিহতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৩৩ বছর বয়সি গ্রাফিক ডিজাইনার মায়া ব্র্যান্ডওয়াইন বলেন, এ যেন এক দুঃস্বপ্ন এবং আমরা কেবল এটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

তেল আবিবের কফিশপে বসে ৪৭ বছর বয়সি গ্রাফিক ডিজাইনার ডর রচেস বলছিলেন, সুযোগ পেলেই আমরা বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে কয়েক ঘণ্টার জন্য সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করি। তারপর বাড়ি ফিরে আসি এবং আবার দুঃস্বপ্নে প্রবেশ করি। মুলি সেগেভ বলেন, যেহেতু যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে এবং আমরা এর শেষও দেখতে পাচ্ছি না, সেহেতু ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি সবার মধ্যেই বড়সড় উদ্বেগ বিরাজ করছে।

এ তো গেল ইসরাইলিদের মানসিক অবস্থা। ইসরাইলের এমন আগ্রাসন চাপ বাড়াচ্ছে দেশটির অর্থনীতির ওপরও। কদিন আগেই ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেন, ইসরাইলের অর্থনীতি দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধের বোঝা বহন করছে। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন লিখেছে, গাজায় হামলা শুরুর এক বছরের মাথায় ইসরাইল এখন একাধিক ফ্রন্টে অগ্রসর হচ্ছে। তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরু করেছে। গাজা ও বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানের চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দিয়েছে। তবে এই সংঘাত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে স্বভাবতই তা ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইলি বাহিনী এখন ৭টি ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর কার্নিত ফ্লাগ সিএনএনকে বলেন, সাম্প্রতিক ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি যদি দীর্ঘতর ও আরও তীব্র যুদ্ধে পরিণত হয়, তাহলে এটি ইসরাইলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ ইসরাইলের অর্থনীতি ধারণার চেয়েও বেশি সংকুচিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমনিতেই ইসরাইলের জিডিপি কমছে। অর্থনীতির তুলনায় দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা। এতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমছে। তার মধ্যে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধের ব্যয়। 

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরুর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছিল, চলতি বছর ইসরাইলের অর্থনীতির পরিসর বাড়বে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এখন অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এটি ১ থেকে ১ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধিও আগের পূর্বাভাসের তুলনায় দুর্বল হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফেরাতে সুদের হার কমানোর অবস্থানে নেই। কারণ ক্রমবর্ধমান মজুরি এবং যুদ্ধের অর্থায়নে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। 

ব্যাংক অব ইসরাইলের গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের কারণে আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত তাদের ৬৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৫০ বিলিয়ন শেকেল ব্যয় হবে। এর মধ্যে সামরিক ব্যয়ের পাশাপাশি বেসামরিক খরচও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে হাজার হাজার ইসরাইলি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে। এখন তাদের পুনর্বাসনে জিডিপির একটি বড় অংশ ব্যয় হবে। 
এই হিসাব যখন করা হয়, তখনও লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হয়নি। কিন্তু এখন লেবাননের পাশাপাশি এই অঞ্চলে ইরানের বিভিন্ন প্রক্সি সংগঠনগুলোর সঙ্গেও সংঘাতের মাত্রা বাড়বে। এতে সামরিক খাতে ব্যয় আরও বাড়বে। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ অবশ্য আশাবাদী, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ইসরাইলের অর্থনীতি আবার স্বরূপে ফিরবে। তবে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, চলমান সংঘাতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হবে। 

ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর কার্নিত ফ্লাগ বর্তমানে ইসরাইল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের রিসার্চ উইংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। তার আশঙ্কা, সামরিক খাতে জোর দিতে গিয়ে সরকার হয়তো বিনিয়োগ খাতে বাজেট কাটছাঁট করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে।

ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষকরাও একই রকমের মত দিয়েছেন। তাদের মতে, গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ ইসরাইলের অর্থনীতিকে যুদ্ধের আগের সময়ের তুলনায় দুর্বল অবস্থায় ফেলে দেবে। এতে করে ইসরাইলের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে।

দেশটির রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ শির হেভার বলেছেন, ইসরাইলি অর্থনীতি অবিরাম জরুরি অবস্থা নিয়ে কাজ করছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক পতন প্রতিরোধে একমাত্র ভরসা। তারপরও বহু মানুষ বিশ্বাস করেন যে, ইসরাইল রাষ্ট্র কখনই এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। ইসরাইলের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা পরিকল্পনা কোম্পানির প্রধান শউল গোল্ডস্টেইন, আমরা ভালো অবস্থায় নেই এবং আমরা সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নই। আমরা একটি কল্পনার মধ্যে বাস করছি।



সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close