আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলাবদ্ধতা, যানজট, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টসহ বিভিন্ন কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। নগর সংস্কারের নামে প্রতিনিয়ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। এতে নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। এ নিয়ে তাদের অভিযোগও কম নয়। নগরবাসীর অভিযোগ, নাগরিক জীবনের প্রতিটি জায়গায় তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব না হলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে রাজধানী ঢাকা। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী বিশে^ বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ষষ্ঠ। তাই বাসযোগ্য নগরায়ণ লক্ষ্যে আজ সোমবার বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব বসতি দিবস-২০২৪। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘তরুণদের সম্পৃক্ত করি, উন্নত নগর গড়ি।’
রাজধানী ঢাকায় প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের অন্যান্য নগরীতে বসবাস করা জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশই রাজধানী ঢাকায় বাস করছে। দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ জায়গাজুড়ে রাজধানী ঢাকার অবস্থান। আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে নগর জীবনে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ। ফলে মোট দেশজ জিডিপির ৩০ শতাংশেরও বেশি আসে ঢাকা থেকে। নগরায়ণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫১ সালের মধ্যে দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে শহরের প্রতিটি সড়কের পাশে অবৈধ পার্কিংয়ের ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং করার কথা থাকলেও খেয়াল-খুশি মতো পার্কিং করছে রাস্তার পাশেই। বুয়েটের গবেষণায় উঠে এসেছে, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি সব মিলিয়ে মাত্র ১০ শতাংশ সময় রাস্তায় চলে। বাকি ৯০ শতাংশ সময় পার্কিং অবস্থায় থাকে। ঢাকাতে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি। এটি যেমন দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে সেই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে রাজধানীবাসীর কর্মঘণ্টা। সাধারণত একটি শহরে আয়তন ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা জরুরি। অথচ রাজধানীর প্রধান সড়ক আয়তনের মাত্র ৩ শতাংশ রয়েছে। তবে বিভিন্ন গলিসড়কসহ সর্বসাকুল্যে রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। এসব সড়কের অধিকাংশই পার্কিংয়ের দখলে। রাজধানীর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং।
জাইকার এক সমীক্ষা দেখা যায়, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ছোট ছোট ৮০০ গাড়ি নামছে। ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন গড়ে ৪ কোটি যাত্রী যাতায়াত হয়। এর ৬০ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবহার করেন। এ যাত্রীদের ৬৭ শতাংশ কেবল বাস ব্যবহার করেন। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সব।
তা ছাড়া রাজধানীতে সবুজায়ন কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অধিক তাপমাত্রায় যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে, তেমনি অতিষ্ঠ নগরবাসীও। এতে অনেক মানুষ হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় কমে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণও। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকায় বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম। বর্ষা মৌসুমেও পরিমাণমতো বৃষ্টি কম থাকে। কিন্তু অল্প বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। তার প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও খালগুলোতে অবৈধ দখলদারিত্ব।
ঢাকায় যেই পরিমাণে শব্দদূষণ হচ্ছে, এতে মানুষের শোনার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে কয়েকগুণ। বধির হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, একটি শহরে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬০ ডেসিবেল থাকা প্রয়োজন, অথচ ঢাকাতে অধিকাংশ স্থানে গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। ফলে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা ও উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমার প্রধান কারণও এটি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৯৯৫ সালে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এটি কমে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশে। অন্য আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঢাকার জনসংখ্যা ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেখা যায় জনসংখ্যা বাড়লেও জলাভূমি কমেছে কয়েকগুণ। যা একটি শহরের জন্য হুমকিস্বরূপ।
নগরবিদগণ বলেন, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে আমলাতান্ত্রিক চিন্তা থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের মতো ভাবতে হবে। তা হলে নগর উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে। ঢাকার নাগরিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও রূপরেখা ঠিক করতে পারেনি। ফলে সরকার জনগণের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান সময়ের আলোকে বলেন, তরুণদের নগর উন্নয়নের কাজে সংযুক্ত করতে হবে। জুলাইয়ের আন্দোলনে তরুণদের হাত ধরে দেশের পটভূমি পরিবর্তন হয়েছে। তাই তারা বাসযোগ্য নগরীর কাজে থাকলে দ্রুত পরিবর্তন আসবে। গত সরকার কমিউনিটিভিত্তিক সব সংগঠনকে দুর্বল করে দিয়েছিল। যার কারণে অনেক কাজই করা যেত না। খাল উদ্ধার, খেলার মাঠ পরিচর্যাসহ নগরকেন্দ্রিক কোনো কাজেই তারা ভূমিকা রাখতে পারেনি। নগরায়ণে যত ধরনের নাগরিক সুবিধার সংকট আছে, তা নিয়ে কাজ করার জন্য তরুণদের সংযুক্ত করা প্রয়োজন। রাজউক ও সিটি করপোরেশন তরুণদের কাছে পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, বসতি দিবসে শুধু নগরায়ণ নয়, গ্রামের প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ সেটিও একটি বসতির অংশ। বাংলাদেশ বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানির মধ্যে রয়েছে। তার প্রধান কারণ ঢাকার উন্নয়নের বিনিয়োগ সঠিক জায়গায় হয়নি। আমরা বড় বড় প্রকল্প করেছি কিন্তু তা থেকে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ভোগ করছি। যাতায়াতের জন্য বাস সার্ভিসও উন্নত হয়নি। রাজনৈতিক কারণে নগর উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তি সুবিধা বেশি হয়েছে। নগরায়ণের সমস্যা সমাধানের জন্য আঞ্চলিক পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তা হলে নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করা যাবে। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাই এটিকে কাজে লাগাতে হবে।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান সময়ের আলোকে বলেন, রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনেক পরিবল্পনা নিয়েছে। আর এগুলোকে যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। কিছু বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবে প্রতিফলন হলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে সহজ হবে। ঢাকা অধিক জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। এই জনবহুল শহরের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প ও বাসযোগ্য নগরায়ণ করার কাজ চলছে।